তরিকুল ইসলাম চতুর্থ পা ধরলেন। বিড়াল তাঁকে কামড়াতে গেল। তিনি পা ছেড়ে দিয়ে বললেন, কাঁটা নাই। বিদায়।
ছাত্রের ডায়েরি
মিসির আলি ছাত্রের ডায়েরি নিয়ে বসেছেন। অল্প কিছু পাতা বাকি। এই পাতাগুলিতে হঠাৎ হঠাৎ কিছু অসংলগ্ন বাক্য ঢুকে পড়েছে। যেমন তারকা চিহ্ন দিয়ে লেখা-পাচ্ছি না কেন? রুলার রুলার।’ লবণ নাই। পাঁচটা পুরো পাতা আছে উল্টো করে লেখা শুধুমাত্র আয়নার সামনে ধরলেই পড়া যায়। Dyslexia নামক ব্যাধির রোগীরা এই ভাবে লেখে। তার কি Dyslexia আছে?
মিসির আলি উল্টো করে লেখা অংশটা আগে পড়লেন। তার আয়না প্রয়োজন হলো না। পড়তে কিছু বেশি সময় লাগল। তাঁর ছাত্র ফারুক লিখেছে।
এই অংশে আমি কিছু অদ্ভুত কথা লিখব। কথাগুলি সাধারণ ব্যাখ্যার বাইরে। সরকারি ছুটির দিন। আমি কলেজে যাই নি। কান্নার শব্দ শুনে উঠে গেলাম। আঙ্গুর কাদছে। আমার কাজের মেয়ে আঙ্গুর খুব ভয় পেয়েছে। সে বসার ঘরের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে কাঁদছিল। আমি তাকে পর্দার আড়াল থেকে বের করলাম। বললাম, কি হয়েছে?
সে বলল, ভয় পাইছি।
কখন ভয় পেয়েছিস?
সকালে।
দিন দুপুরে কিসের ভয়! কি দেখে ভয় পেয়েছিস?
মেয়েটা কিছু বলে না। শুধু কাঁদে আর এদিক ওদিক তাকায়। বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেয়। কাঁদতে কাঁদতে তার হেচকির মতো উঠে গেল। হিস্টিরিয়াগ্ৰস্ত অবস্থা। মেয়েটির একটিই কথা সে এই বাড়িতে থাকবে না। এখুনি চলে যাবে।
তার ভয় পাওয়া বিষয় নিয়ে যে আয়নার সঙ্গে আলাপ করব সে উপায়। নেই। আয়নার নতুন অভ্যাস হয়েছে। নদীর পাড়ে যাওয়া। সে নদীর পাড়ে ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। আমাদের কলেজের পাশেই নদী, নাম বড় গাঙ্গ। আয়না খুঁজে খুঁজে নদীর পাড়ে একটা ছাতিম গাছ বের করেছে। সে গাছের গুড়িতে বসে থাকে। তাকে নিয়ে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কানায়ুষাও আছে। যেমন তার মাথার ঠিক নাই। সে নিজে নিজে হাত নেড়ে কথা বলে, হাসে।
আমি আঙুরকে শাস্ত করার অনেক চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। আমি বললাম, আয়না ফিরুক তারপর তোকে আমি তোর বাড়িতে দিয়ে আসব। আঙ্গুর তাতেও রাজি না। তাকে এখনই দিয়ে আসতে হবে। সে আর এক মুহূর্তের জন্যেও থাকবে না। থাকলে না-কি সে মরে যাবে।
বাধ্য হয়েই আমি তাকে নিয়ে রওনা হলাম। তার বাবা মা শহরের এক বস্তিতে থাকে। রিকশায় যেতে পনেরো বিশ মিনিট লাগে। রিকশায় উঠে আঙ্গুর স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমাকে ভয় পাওয়ার ঘটনা নিচু গলায় বলল।
যে ঘর ঝাঁট দিচ্ছিল। তার আপামণি আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছিল। হঠাৎ সে দেখে আপামণির হাত থেকে চিরুনী পড়ে গেছে আর আপামণি আয়নাটার ভেতর ঢুকে গেছে।
আমি তার কথার কোনো গুরুত্ব দিলাম না। কি দেখতে কি দেখেছে। মানুষ আয়নার ভেতর ঢুকে যাবে কি ভাবে? সে যদি বলতে আপামণি হঠাৎ শূন্যে মিলিয়ে গেছে তাও একটা কথা হতো। মানুষের চোখে Blind spot বলে একটা ব্যাপার আছে। হঠাৎ কোনো বস্তু Blind spot এ পড়ে গেলে তা দেখা যায় না। ফেরাউনের কিছু যাদুকর Blind spot-এর বিষয়টা জানতেন। তার সাহায্যে তাঁরা জীবন্ত বস্তু অদৃশ্য করার খেলা দেখাতেন।
আমি আয়নাকেও কিছু বললাম না। আঙ্গুর তার বাবা-মা’কে দেখার জন্যে হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে কয়েকদিনের জন্যে তাকে বাবা-মা’র কাছে রেখে এসেছি। এইটুক বললাম। আয়না বলল, তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। মেয়েটাকে ছাড়া বাসাটা খালি খালি লাগছে।
আমি বললাম, আচ্ছা।
আয়না বলল, মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ। তাকে পালক নিলে কেমন হয়? আমাকে মা ডাকবে। তোমাকে বাবা ডাকবে।
আমি বললাম, মেয়েটাকে পালক নিতে হবে কেন? আমাদের নিজেদের ছেলেমেয়ে হবে। তারা বাবা-মা ডাকবে।
আয়না বলল, আমাদের ছেলেমেয়ে হবে না।
আমি বললাম, কেন হবে না?
আয়না তার জবাব না দিয়ে আমার সামনে থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেল। তার পছন্দের জায়গায় গিয়ে বসল। তার বারান্দায় বসার অর্থ এক দুই ঘণ্টা সে ঝিম ধরে থাকবে। হাত নাড়বে, বিড় বিড় করবে।
ছোট মেয়েটার অনুপস্থিতি যে আমাদের জীবনযাত্রায় বড় কোনো পরিবর্তন আনল তা না। সব কিছু আগের মতো চলতে লাগল। আয়না গুছিয়ে সংসার করে। সে যে কাজ করছে— বাসন ধুচ্ছে কাপড় ধুচ্ছে কিংবা রান্না করছে তা বুঝাই যায় না। তার সব কাজকর্ম নিঃশব্দ।
আমি একটা ঠিক বুয়া রাখতে চেয়েছিলাম। সে রাজি হলো না। সে বলল, ওদের গা থেকে আমি নোংরা গন্ধ পাই। আমার শরীর ঘিনঘিন করে। গন্ধ বিষয়ে আমার সমস্যা আছে। আয়নার এই কথা খুবই সত্যি। মাছের গন্ধ সে সহ্যই করতে পারে না। আমাদের বাসায় মাছ রান্না হয় না।
পাশের ফ্ল্যাটের মাছ রান্নাও সে নিতে পারে না। সারাক্ষণ নাকে রুমাল চাপা দিয়ে রাখে কিংবা নদীর পাড়ের ছাতিম গাছের নিচে বসে থাকে।
আয়নার সঙ্গে আমার কথাবার্তাও তেমন হয় না। আমি প্রশ্ন করলে জবাব দেয় তাও সবসময় না। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কথা বলে আমাকে চমকে দেয়। যেমন একদিন বলল, ফ্ল্যাট থ্রি-বি-তে একটা কালো লম্বা ছেলে থাকে দেখেছে? গোফ আছে। সব সময় মাথা নিচু করে হাঁটে। খুব সিগারেট খায়।
আমি বললাম, দেখেছি।
তাকে চেন?
চিনি। ওর নাম মুকসেদ। বাংলার প্রফেসার জালাল সাহেবের শালা। চাকরির খুঁজে এসেছে।
আয়না বলল, ও একটা খুনি। পাঁচটা খুন করেছে।
আমি চমকে উঠে বললাম, কি বল তুমি।