তাই না-কি?
অবশ্যই। মহাশোল খেয়েছেন? আমরা বলি মাশুল। পাহাড়ি নদীর মাছ। অনেকটা রুই মাছের মতো তবে মুখটা রুই মাছের চেয়ে লম্বা। হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়।
মাশুল মাছ নিয়ে কোনো ছড়া কি আছে?
অবশ্যই আছে-মাশুল মাছ আইছে। জমি কেইচা খাইছে। এই মাছ রান্না হলে শ্বশুর জামাইকে না দিয়ে নিজে খায়।
খাওয়া দাওয়া মিসির আলির কাছে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তরিকুল ইসলামের পাল্লায় পড়ে তাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল। কৈ মাছ তিনি বেশ আরাম করেই খেলেন।
দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাসও ছিল না। আজ খাওয়া দাওয়ার পর লেপ গায়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। চোখ মেলেই দেখেন চায়ের কাপ হাতে আয়না দাঁড়িয়ে। আয়না বলল, এই নিয়ে আপনার কাছে তিনবার এসেছি। আপনি ঘুমুচ্ছিলেন দেখে জাগাই নি। বিছানায় বসে চা খাবেন না। কারান্দায় বসবেন?
মিসির আলি বললেন, বিছানাতেই বসি। তুমিও চেয়ার টেনে বস। আমার ধারণা তুমি কিছু বলতে চাও। সেটা কি?
হিপনোটিক সাজেশনের বিষয়টা জানতে চাই। এত সহজে একজনকে ঘুম পাড়ানো যায়। আমি জানতাম না।
মিসির আলি বললেন, মানুষের ব্ৰেইন অদ্ভুত কোনো কারণে এমন ভগবে তৈরি যে অন্যের কথায় প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। কারো সামনে চোখ বন্ধ করা মানে তার আয়ত্তে চলে যাওয়া।
কেন এ রকম?
মিসির আলি বললেন, আমি পুরোপুরি জানি না। তবে এর Deep rooted কারণ থাকতে পারে। শুরুতে মানবগুষ্ঠি ভয়ংকর বিপদে থাকতো। তাদেরকে দলপতির সব কথা শুনতে হতো। দলপতির নির্দেশ না মানার অর্থ হচ্ছে মৃত্যু। বিশেষ করে রাতে, যখন চারদিক অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমাদের জীন সেই ভাবেই তৈরি। আমরা অতি সুসভ্য প্রাণী কিন্তু আমাদের একটা অংশ প্রাচীন পৃথিবীর।
আয়না বলল, আপনি যখন কাউকে সাজেশন দিচ্ছেন তখন সে আপনাকে লিডার মানছে। যা করতে বলছেন তাই-সে করছে?
অনেকটা সে রকম।
আমাকে হিপনোটাইজ করতে পারবেন?
চেষ্টা করে দেখতে পারি।
আমি কি আপনাকে হিপনোটাইজ করতে পারব? আপনি যে ভাবে করেছেন সে ভাবে।
মিসির আলি বললেন, পারবে। কারণ আমি তোমাকে সাহায্য করবো। প্ৰাণপণে নিজেকে আড়াল রাখার চেষ্টা করব না। তাছাড়া প্রকৃতি প্রদত্ত এই ক্ষমতা তোমার ভালোভাবেই আছে। তোমার স্বামীকে তুমি তোমার ছবি আয়নায় দেখিয়েছ। হিপনোটাইজ করেই দেখিয়েছ।
কেন বলছেন?
প্ৰথমে তুমি তোমার স্বামীকে টেলিফোন করলে। অনেকদিন তোমার সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। সে তোমার কণ্ঠস্বর শুনেই মন্ত্ৰমুগ্ধ। তখন তাকে বললে আয়না দেখতে। সে সাজেশান পেয়ে গেল। তার প্রবল তৃষ্ণা হলো আয়নায় তোমাকে দেখার। দেখতে পেল। আয়নায় মানুষ নিজের ছবি দেখে। সে কিন্তু নিজের ছবি দেখেনি। এর অর্থ একটাই আয়নার পুরো ব্যাপারটাই তার কল্পনা।
আয়না বলল, স্যার আরেক কাপ চা-কি আপনাকে দেব?
মিসির আলি বললেন, আর চা খাব না।
আয়না বলল, আগামীকাল চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
আয়না মাথা নিচু করে হাসল। মিসির আলি বললেন, হাসছ কেন?
আয়না বলল, আগামীকাল আপনি যেতে পারবেন না।
কেন যেতে পারব না?
আয়না বলল, ঘুম ভাঙার পর আপনার মনে হবে কি দরকার ঢাকা যাওয়ার? আরো কয়েকটা দিন থাকি। ঢাকায় আমার তেমন জরুরি কাজও তো নেই। এখানে দুদিন থাকবেন বলে এসেছিলেন। স্যার সাতদিন পার হয়েছে। এত দিন পার হয়েছে আপনি নিজেও কিন্তু জানেন না।
মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, সাত দিন পার হয়েছে! কি বল তুমি?
আয়না বলল, জ্বি স্যার সাত দিন। আমি আপনাকে আটকে রেখেছি। আমি যখন আপনাকে যেতে দেব তখন যেতে পারবেন। তার আগে না।
মিসির আলি বললেন, তোমার ধারণা তোমার অনেক ক্ষমতা?
আয়না শান্ত গলায় বলল, স্যার আমার অনেক ক্ষমতা। আমি নিজে না বললে আমার বিষয়ে আপনি কিছুই জানতে পারবেন না। আপনার ছাত্রও কিছু বুঝতে পারে নি। আপনি শুধু শুধুই তার খাতা পড়ছেন।
পড়া বন্ধ করতে বলছ?
না।
আমাকে যেতে দিচ্ছ না কেন?
আয়না বলল, মনে হয় আমি আপনার প্রেমে পড়েছি।
হতভম্ব মিসির আলি বললেন, কি বলছ তুমি?
আয়না বলল, প্রেমে পড়া অতি তুচ্ছ এবং হাস্যকর একটা জৈবিক বিষয়। এখানে আধ্যাত্মিকতার কিছু নেই। আমি আপনার ছাত্রের স্ত্রী নই। আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমার প্রেমে পড়তে সমস্যা কি? আমি আপনার সঙ্গে ঢাকা যাব। মাজেদি একা কোন যাবে?
মিসির আলি তাকিয়ে আছেন। তার বুক ধড়ফড় করছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। কি বলছে এই মেয়ে।
আয়না বলল, স্যার আপনি এত নার্ভাস হয়ে গেছেন কেন? আমি আপনার সঙ্গে ঠাট্টা করছি। আপনি লজিক বুঝেন, কত কিছু বুঝেন। ঠাট্টা বুঝেন না? আশ্চর্য তো।
বিড়ালের ম্যাও ম্যাও শব্দ আসছে। মিসির আলি বারান্দায় এসে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলেন। মাজেদের কোলে মিশমিশে কালো এক বিড়াল। হেডমাস্টার সাহেব বিড়ালটার পা চেপে ধরে আছেন। বিড়াল উদ্ধার পাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে কামড়াতেও যাচ্ছে।
মিসির আলি বললেন, কি ব্যাপার?
তরিকুল ইসলাম বললেন, গলায় কৈ মাছের কাটা ফুটেছে। কৈ মাছের কাটা বরাশির মতো। একবার ফুটলে ছাড়ন নাই। এই কারণেই বিড়ালের পা ধরে বসে আছি।
বিড়ালের পা ধরলে গলার কাঁটা যাবে?
তরিকুল ইসলাম বললেন, অবশ্যই যাবে। গলার কাঁটা দূর করার এটাই একমাত্র অসুধ। প্রতিটি পা একবার করে ধরতে হয়। তিনটা পা ধরেছি। একটা বাকি আছে। ঐটা ধরা মাত্র কাঁটা চলে যাবে।