সন্ধ্যা বেলায় পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে গেল। আয়না বিম মেরে গেল। কথা বললে তাকায়, জবাব দেয় না। আমি বললাম, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে? সে না সূচক মাথা নাড়ল। রাতে খাবার খেল না। আমি বললাম, শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে পড়।
আয়না বলল, আমি আলাদা শোব।
আলাদা শোবে মানে?
আয়না আঙ্গুল উঁচিয়ে গেস্ট রুম দেখিয়ে বলল, ঐ ঘরটায় শোব।
কেন?
আয়না আমার দিকে তাকিয়ে হাসল আর সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে মনে হলো সে আলাদা ঘুমাবে। এটাই তো স্বাভাবিক। সবার প্রাইভেসি আছে। একা ঘুমালে প্রাইভেসি রক্ষা হয়। স্বামীর সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমানো হচ্ছে মধ্যযুগের বর্বরতার মতো। আধুনিক যুগে স্বামী-স্ত্রী আলাদা আলাদা ঘরে বাস করবে। স্বামী তার নিজের মতো তার ঘর সাজাবে। স্ত্রী তার রুচি মতো সাজাবে।
আমি বললাম, অবশ্যই তুমি আলাদা ঘুমাবে। সেটাই উচিত এবং শোভন।
আয়না বলল, থ্যাংক য়ু।
তখনো আমি বুঝতে পারিনি যে আয়না আমার চিন্তা করার ক্ষমতা কনট্রোল করছে। তার ইচ্ছামতো ভাবতে আমাকে বাধ্য করছে। আমি আলাদা ঘুমুতে গেলাম। ভালো ঘুম হলো কড়া ঘুমের অনুধ খেলে যেমন ঘুম হয় তেমন ঘুম।
সকাল বেলা আয়না স্বাভাবিক হয়ে গেল। হাসি খুশি। আঙ্গুর মেয়েটাকে নিয়ে অনেকগুলি ফুলের টব কিনে বারান্দায় সাজাল। সতরঞ্জি কিনে আনল। বারান্দায় বিছিয়ে আসনের মতো করল। আমাকে বলল, এটা হলে আমার আসন। যখন আমার মন খারাপ থাকবে তখন আসনে বসে থাকব।
আমি বললাম, ভালো তো!
সন্ধ্যা হবার পর পর আয়না বারান্দায় বসল। আমার মনে হলো এটাই তো স্বাভাবিক। এখন তার কাছে যাওয়া হবে খুবই অনুচিত। সবারই নিজের আলাদা কিছু সময় থাকা দরকার। সে বারান্দায় বসে নিজের মনে ভাবছে ভাবুক না।
আমি এক রাতের খাবার খেয়ে ঘুমুতে গেলাম। মরার মতো ঘুমালাম। ঘুম ভাঙল আয়নার ডাকে। সে চা বানিয়ে এনেছে। আয়না বলল, দশটা বাজে, এখনো ঘুমােচ্ছ? সকালে তোমার ক্লাস নাই?
ক্লাস নিলাম। ছাত্রভর্তি বিষয়ে প্রিন্সিপ্যাল স্যার কিছু দায়িত্ব দিয়েছেন তার পিছনে সময় দিলাম। ছাত্রদের হোস্টেলে দুই দলে মারামারি হয়েছে! আমি হোস্টেলের অ্যাসিসটেন্ট সুপার। দুই দলকে শান্ত করার প্রক্রিয়ায় বেশ সময় গেল। আমি নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত কিন্তু মন পড়ে আছে বাসায়। সারাক্ষণ আয়নাকে নিয়ে ভাবছি। আমি যে তার হাতের পুতুল হয়ে গেছি। এই বিষয়টা পরিষ্কার।
গভীর প্রেম মানুষকে পুতুল বানিয়ে দেয়। প্রেমিক প্রেমিকার হাতের পুতুল হন কিংবা প্রেমিকা হয় প্রেমিকের পুতুল। দু’জন এক সঙ্গে কখনো পুতুল হয় না। কে পুতুল হবে। আর কে হবে সূত্রধর তা নির্ভর করে মানসিক ক্ষমতার উপর। মানসিক ক্ষমতা যার বেশি তার হাতেই পুতুলের সূতা।
আমার সূতা আয়নার হাতে। সে আমাকে নিয়ে খেলছে। কিন্তু কেন? আমার জন্য তার কোনো ভালোবাসা কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। সে আছে সম্পূর্ণ তার নিজের ভুবনে।
মিসির আলি খাতা বন্ধ করলেন। তরিকুল ইসলাম মাছ নিয়ে ফিরেছেন। হাসি মুখে বললেন, আপনি বিরাট ভাগ্যবান মানুষ। আপনার কপালের কারণে এত বড় কৈ মাছ পেয়েছি। দেখেন মাছ দেখেন। ছবি তুলে রাখার মতো মাছ।
মিসির আলি চোখে-মুখে আগ্রহ ফুটিয়ে মাছ দেখলেন।
এই সাইজের কৈ কখনো দেখেছেন?
না।
পেটের আশে লাল চকচকে ভাব দেখছেন?
জ্বি।
এটা হলো রানী কৈ-এর লক্ষণ।
মিসির আলি বললেন, কৈ মাছে রাজা-রাণী আছে?
অবশ্যই আছে। আজ হলো কৈ দিবস। কৈ মাছের ভাজা খাবেন। মটরশুটি দিয়ে ঝোল খাবেন। আরেকটা আইটেম হলো কৈ মাছের ভর্তা।
কৈ মাছের ভর্তাও হয়?
তরিকুল ইসলাম আনন্দিত গলায় বললেন, আপনারা যারা শহরবাসী তাদের ধারণা শুধু টাকি মাছের ভর্ত হয়। কৈ মাছেরও ভর্ত হয়। কৈ ভতাঁর পাশে অন্য ভর্তা দাঁড়াতেই পারবে না। আজকের প্রতিটা আইটেম আমি রান্না করব।
আপনি রাধতেও পারেন?
তরিকুল ইসলাম বললেন, ভালো কোনো মাছ পেয়ে গেলে অন্যের হাতে ছাড়তে ইচ্ছা করে না।
রান্না শিখেছেন কোথায়?
মা’র কাছে শিখেছি। মা রান্না করতেন। আমি পাশে বসে থাকতাম। আজ আমি রান্না করব। আপনি পাশে বসে থাকবেন। রান্না দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে,
মিসির আলি অবাক হয়ে লক্ষ করলেন রান্না দেখে তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। রান্না বিষয়টাতে যে এত ধরনের জটিলতা আছে তা তিনি আগে লক্ষ করেন নি। আগুনের আঁচ বাড়ানো হচ্ছে, কমানো হচ্ছে। পাতিলের উপর কখনো ঢাকনা দেয়া হচ্ছে কখনো বা সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
তরিকুল ইসলাম বললেন, আজ খাওয়া শুরু হবে উচ্ছে ভাজি দিয়ে। ভয়ংকর তিতা। তিতা দিয়ে শুরু করলে কি হয় জানেন?
কি হয়?
প্রথমেই শরীরের সিস্টেটমে ধাক্কা লাগে। শরীর সেই ধাক্কা খেয়ে অন্য খাবারগুলির জন্যে তৈরি হয়। বাকি খাবারগুলি তখন অসাধারণ লাগে।
রান্না চলেছে আর চলছে তরিকুল ইসলাম সাহেবের মুখ। তিনি কথার রেলগাড়ি চালিয়েছেন। সব কথাই খাদ্য সম্পর্কিত।
মিসির আলি সাহেব! রিটা মাছ খেয়েছেন?
খেয়েছি মনে হয়। নামে মনে করতে পারছি না।
রিটা এমন মাছ যে একবার খেলে ভুলবেন না। রিটা সম্পর্কে কবিতাই আছে–
রিটা
হাড়ে গোশতে মিঠা।
মিসির আলি বললেন, একবার খেয়ে দেখতে হয়।
তরিকুল ইসলাম বললেন- ঢাকা শহরে এই মাছ পাবেন ঠিকই— সবই মরা। বরফ দেয়া। রিটা মাছ জীবন্ত অবস্থায় কিনতে হয়। কাটার দশ মিনিটের মাথায় রান্না করতে হয়। দশ মিনিট পরে রান্না করবেন মাছ লাগবে। বালির মতো।