জ্বি।
আপনি কল্পনা করুন নতুন একটা জায়গায় বেড়াতে গেছেন। জায়গাটা ফাঁকা। গাছপালা ছাড়া আর কিছু নেই! জায়গাটা কি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছেন? চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন।
তরিকুল ইসলাম চোখ বন্ধ করে গাঢ় স্বরে বললে, দেখতে পাচ্ছি।
জায়গাটা কেমন একটু বলুন তো?
সুন্দর। খুব সুন্দর। ফুলের বাগান আছে।
ঠাণ্ডা বাতাস কি বইছে?
জি।
ফুলের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছেন না?
পাচ্ছি।
একটা পুরানো কাঠের বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন?
হুঁ।
দোতলা বাড়ি না?
জ্বি।
খুঁজে দেখুন দোতলায় উঠার সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটা বের করুন।
আচ্ছা।
সিঁড়ি খুঁজে বের করে আমাকে বলুন। সিঁড়ি পেয়েছেন?
পেয়েছি।
এখন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করুন। এক একটা ধাপ উঠবেন। আর আপনার চোখ গাঢ় হতে থাকবে। সপ্তম ধাপে উঠে গভীর ঘুমে আপনি তলিয়ে যাবেন। উঠতে শুরু করুন। প্রথম ধাপ উঠেছেন?
জ্বি উঠেছি।
দ্বিতীয় ধাপ?
হুঁ।
ঘুম পাচ্ছে।
হুঁ।
তৃতীয়।
হুঁ।
আপনার শরীর ভারী হয়ে গেছে। আপনার পা তুলতেও কষ্ট হচ্ছে চতুর্থ ধাপ। উঠেছেন?
হুঁ।
চতুৰ্থ, পঞ্চম এখন সপ্তম ধাপ উঠবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়বেন। আপনি পা দিয়েছেন সপ্তম ধাপে।
তরিকুল ইসলাম বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁর মাথা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসেছে। আয়না। আপলক তাকিয়ে আছে।
মিসির আলি বললেন, তরিকুল ইসলাম সাহেব।
জ্বি।
ঘুমাচ্ছেন?
জ্বি।
আপনার কেমন লাগছে?
ভালো।
আমি দু’বার হাত তালি দেব। তালির শব্দে আপনার ঘুম ভাঙবে। ঘুম ভাঙার পর আপনি কুকুর ভয় পাবেন না। কুকুর ভীতি আপনার পুরোপুরি দূর হবে।
মিসির আলি দু’বার হাত তালি দিলেন। তরিকুল ইসলাম চোখ মেললেন। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন। আয়না বলল, বাবা কুকুরের ভয়টা কি গেছে?
অরিকুল ইসলাম বললেন, কুকুরের কিসের ভয়?
আয়না বলল, তুমি স্যারের জন্যে মাছ কিনতে যাবে না?
তরিকুল ইসলাম বললেন, এখনই যাচ্ছি।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। স্বাভাবিক ভঙিতে এক তলায় নামলেন এবং মাছের সন্ধানে বের হয়ে গেলেন। কুকুর ভীতি এখন তাঁর আর নেই।*
[* এই বইয়ে লেখা হিপনোটিক সাজেশানের পদ্ধতিটি কেউ ব্যবহার করতে চাইলে সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। Trance states-এ চলে যাওয়া কাউকে ভুল সাজেশান কখনোই দেয়া ঠিক না। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।–হুমায়ূন আহমেদ।]
কদম গাছের নিচে বেতের চেয়ার পাতা হয়েছে। আজ কুয়াশা কম। মিসির আলি ছাত্রের ডায়েরি নিয়ে বসেছেন। তাকে চা দেয়া হয়েছে। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন।
মাজেদি অসাধ্য সাধন করেছে। সে মিসির আলির চুল টেনে দিচ্ছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার মিসির আলির ভালো লাগছে। ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে। মিসির আলি মাজেদের সঙ্গে গল্প করছেন।
মাজেদ মিয়া!
জি স্যার।
চুল টানা কোথায় শিখেছিস?
মাজেদ বলল, লেখাপড়া শিখা লাগে। এইগুলা শিখা লাগে না।
কিছু একটা শেখাতো উচিত। লেখাপড়াটা শিখ।
আপনে বললে শিখব। তয় সমস্যা আছে।
কি সমস্যা?
বেতন দেয়া লাগে। মা একবার আমার ইসকুলে দিতে চাইল। বাপজান তারে দিল দাবর।
দাবর কি?
বড় ধমকরে বলে দাবর।
দাবর দিয়ে কি বলল?
বাপজান বলল, এই বান্দি! ইসকুলে যে দিবি পুলার বেতন কে দিব? তর বাপে দিব?
নিজের স্ত্রীকে বান্দি বলা এটা কেমন কথা।
মাজেদ বলল, আমার ব্যাপজানের মতো যারা গরিব তার পরিবারেরে বান্দি বললে দোষ হয় না।
মিসির আলি বললেন, তোর অনেক বুদ্ধি। তোকে পড়াশোনা করতেই হবে। বেতন আমি দিব। ঠিক আছে?
জে ঠিক আছে। তয় বাপজানের কাছে টেকা দিয়া দিয়া গেলে বাপজান খরচ কইরা ফেলব। হেড স্যারের কাছে টাকা দিয়া পেলে ভালো হয়।
মিসির আলি বললেন, সবচে ভালো হয় তুই যিদ আমার সঙ্গে ঢাকায় যাস। আমি লেখা পড়া দেখিয়ে দিতে পারব। যাবি?
মাজেদি বলল, এক জোড়া স্যান্ডেল। কিন্যা দিলে যাব। শহর বন্দরে খালি পায়ে যাওয়া ঠিক না। এই জন্যে সেন্ডেল।
সেন্ডেল অবশ্যই কিনে দেব। এখন খেলতে যা। চুল টানতে হবে না।
আমি যে আপনের লগে যাইতেছি মারে বলব?
অবশ্যই বলবি। মা’কে বলবি, বাবাকে বলবি। তাদের অনুমতি নিতে হবে না?
মিসির আলি ডায়েরি পড়ায় মন দিলেন। ডায়েরি আজ দিনের মধ্যেই পড়ে শেষ করতে হবে। আগামীকাল ঢাকায় চলে যাবেন। হাতে সময় নেই।
শ্রাবণ মাসের শেষে আমি আয়নাকে নিয়ে এলাম। সে আগ্রহ নিয়ে ঘর বাড়ি দেখল। বিশাল বারান্দা দেখে খুশি হলো। দুপুরে নিজেই রান্না করল, ডিম ভাজিল ৷ ডাল রাঁধল। কাজের একটা বাচ্চা মেয়ে জোগাড় করে রেখেছিলাম আট নয় বছর বয়স। নাম আংগুর। তার চুল বেঁধে দিল। চুল বাঁধতে বাঁধতে অনেক গল্প করল।
নাম আঙ্গুর। আঙ্গুর। কখনো খেয়েছিস?
না।
আচ্ছা তোকে খাওয়াব। তোর স্যারকে বলব নিয়ে আসতে। বারান্দার টবে আঙ্গুরের চাষও করব। তুই গাছে নিয়মিত পানি দিবি। পারবি না?
পারব।
লেখাপড়া জানিস?
না।
লেখাপড়া শিখতে হবে। মুর্থ হয়ে থাকা যাবে না। তোর স্যারকে বলে তোকে স্কুলে ভরতি করিয়ে দেব।
আচ্ছা।
গান জানিস?
রূপবান পালার গান জানি।
গেয়ে শুনা।
আঙ্গুর মাথা নিচু করে গান ধরল, ও দাইমা। দাই মা গো।
আনন্দ আমার চোখে পানি এসে গেল। সুখী পরিবার শুরু হতে যাচ্ছে। আমি আত্মীয় পরিজন ছাড়া একজন মানুষ। সারা জীবন একা থেকেছি। আর এক থাকতে হবে না। সংসারে শিশু আসবে। সে হাসবে খেলবে। আমি হাঁটু গেড়ে ঘোড়া হব। সে ঘোড়ার পিঠে চড়বে। আয়না তাকে ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়বে—খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?