আমি বললাম, কি দেখ?
নোশিন আবার তার মা’র দিকে তাকালো।
আমি বললাম, তোমার সমস্যা তোমাকেই বলতে হবে। খোলাখুলি বলতে হবে এবং আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে হবে। কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস টেন।
তুমি পড়াশোনায় কেমন?
ভাল।
সায়েন্স গ্রুপ?
জ্বি।
এইত কথা বলতে পারছি। এখন সমস্যা বলা শুরু কর। কোক বা পেপসি খাবে আনিয়ে দেব?
না।
শোন নোশিন! তুমি পেপসি বা কোক খেতে চাচ্ছ। তোমার বডি ল্যাংগুয়েজ তাই বলছে। কিন্তু মুখে বলছ না। আমি আনিয়ে দিচ্ছি। কি আনতে বলব কোক?
সেভেন আপ।
আমি সেভেন আপ আনতে বেয়ারাকে পাঠালাম। নোশিন অনেকখানি সহজ হল। সে হাত মুঠি করে বসেছিল। হাতের মুঠি সামান্য আলগা করল। কেউ যখন কিছু বলতে চায় না, তখন হাত মুঠিবদ্ধ করে রাখে।
সেভেন আপের গ্লাসে চুমুক দিয়ে নোশিন তার সমস্যাটা বলল, সে না কি খুব ছোটবেলা থেকেই জন্তুর মত একটা কিছু দেখে। জন্তুটা থাকে মানুষের পেছনে। সব মানুষের পেছনে না। যারা অল্পদিনের মধ্যে মারা যাবে। তাদের পেছনে। জন্তুটা দেখতে কিছুটা মানুষের মত। তবে মুখ গরুর মুখের মত লম্বা। তাদের চোখও গরুর চোখের মত। সেই চোখের মণি কখনো স্থির না। সব সময় ঘুরছে। জন্তুর গা থেকে কাঠপোড়ার গন্ধ আসে। তার হাত পা মানুষের মত। শুধু হাতের আঙুল অস্বাভাবিক লম্বা।
নোশিনের মা বললেন, মেয়ে যা বলছে সবই সত্যি। আমাদের যে সব আত্মীয় স্বজন মারা গেছেন, তাদের প্রত্যেকের পেছনে সে এই জন্তু দেখে ভয়ে অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করেছে। যাদের পেছনে সে এই জন্তু দেখেছে তারা প্ৰত্যেকেই সাত থেকে দশদিনের ভেতর মারা গেছে।
আমি বললাম, নোশিন জন্তুটার সাইজ কি? কত লম্বা?
নোশিন বলল, যার পেছনে সে দাঁড়ায় তারচেয়ে সে এক ফুটের মত লম্বা হয়। তার মাথার উপর দিয়ে জঞ্জটার মাথা দেখা যায়। জন্তুটা গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে থাকে।
জন্তুটার গায়ে কাপড় দেখেছ? সে দেখতে মানুষের মত? মানুষ জামা কাপড় পরে। জন্তুটা কি পরেছে?
নোশিন এই প্রশ্নের জবাব দিল না। চোখ নামিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি তাকে নিয়ে সেদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজে গোলাম। তাকে বললাম, তুমি আমাকে সাতজন রোগী দেখাও যাদের পেছনে ঐ জন্তু দাঁড়িয়ে আছে।
নোশিন দেখাল। আমি রোগীদের নাম ধাম লিখে চলে এলাম। নোশিনকে বললাম, পরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।
আশ্চর্য হলেও সত্যি সাতজন রোগীই দশ দিনের মাথায় মারা গেল। নোশিনকে নিয়ে এই পরীক্ষা আরো দুইটা হাসপাতালে করলাম। তার একটি হচ্ছে আজমপুর সরকারি মেটার্নিটি ক্লিনিক। যেখানে অনেক সময় মা এবং নবজাতক দু’জনই মারা যায়। নোশিন তাও ঠিকঠাক মত বলতে পারল।
সে বলল যে সব রোগী বিছানায় শুয়ে থাকে জন্তুটা তার পাশে শুয়ে থাকে। বেশির ভাগ সময় গলা জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। নবজাতক শিশুর সঙ্গে যে জন্তুটা শুয়ে থাকে, সেই জন্তুটার সাইজ শিশুর চেয়ে সামান্য বড়।
আমি একটি হাইপোথিসিস দাঁড়া করালাম। জটিল কিছু না। সহজ ব্যাখ্যা। মেয়েটি কোনো বিশেষ উপায়ে মানুষের মৃত্যু sense করতে পারে। হয়ত কোনো গন্ধ পায় বা এরকম কিছু। মৃত্যু সেন্স করার পর পরই তার ব্রেইন একটা কাল্পনিক ভয়ংকর জন্তুর মূৰ্তি তৈরি করে। তার ভেতর illusion তৈরি হয় যে সে জন্তু দেখছে।
পাশাপাশি আরেকটা হাইপোথিসিস দাঁড়া করলাম। এই হাইপোথিসিসে মেয়েটির ভবিষ্যত দেখার ক্ষমতা আছে। পুরো ভবিষ্যত না দশ বারোদিনের ভবিষ্যত। এর মধ্যে যারা মারা যাবে সে জানে, তাদের পেছনেই জন্তু কল্পনা করে নেয়।
আমি প্রায় এক বছর এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলাম। প্যারানরম্যাল ভুবনে নোশিনের মত আর কোনো উদাহরণ আছে কিনা জানার চেষ্টা করলাম। অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তখন ইন্টারনেট শুরু হয়নি। অনেক চিঠিপত্র চালাচালি করতে হল। বলিভিয়ার এক বৃদ্ধের খোঁজ পাওয়া গেল যে মানুষের মৃত্যুর দিন ক্ষণ বলতে পারে তবে সে কোনো জন্তু দেখে না। তার নাম সিমন ডি শান। যখন ভাবছি সরাসরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করব হঠাৎ খবর পেলাম নোশিন তার নিজের পেছনে একটা জন্তু দেখছে।
মিসির আলি বললেন, আজ এই পর্যন্ত। বাকিটা অন্য সময় বলব।
আয়না বলল, অন্য সময় বলবেন মানে? এখনই গল্প শেষ করবেন। গল্প শেষ না করে উঠতে পারবেন না।
মিসির আলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, কেন পারব না বল? তুমি সবার উপর প্রভাব খাটাচ্ছ। আমার উপরও প্রভাব ফেলতে চাচ্ছি। আমাকে এই চক্র থেকে বের হতে হবে। তুমি ফুটবল খেলতে এসে বল রাখছি নিজের পায়ে। তা আর হবে না। বল নিয়ে আসতে হবে। আমার নিজের কোর্টে।
আয়না বলল, গল্পের শেষটা খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
কোনও এক সময় অবশ্যই জানবো।
সেটা কখন? আজ?
মিসির আলি বললেন, জানি না। তিনি বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। আয়না আসছে না। সে তার জায়গাতেই বসে আছে। তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। তার চেহারা বিষণ্ণ। কেঁদে ফেলার আগে কোনো তরুণীকে যে রকম দেখায়, তাকে সে রকম দেখালো। মিসির আলির মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। তিনি বললেন, আয়না এসো। গল্পের শেষটা শুনে যাও। বাড়ির দিকে যেতে যেতে গল্পটা করি। আয়না প্ৰায় দৌড়ে এল। মিসির আলি ছোট ছোট স্টেপ নিয়ে এগুচ্ছেন, গল্প করছেন। আয়না। কান পেতে আছে।
বুঝতেই পারছি নোশিন মেয়েটির বাড়িতে কান্নার সীমা রইল না। তখনি তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়া হল। যদি কোনো রোগ ধরা পড়ে তার চিকিৎসা যেন শুরু হয়।