দিন।
তোমার বাবা যখন সিগারেট খান তখন উপরের দিকে ধোঁয়া ছাড়েন। তুমি যখন সামনে থােক তখন মেঝের দিকে ধোঁয়া ছাড়েন। এর অর্থ তুমি সামনে থাকলে তাঁর Confidence level নেমে যায়। আমাদের মন অনেক কিছু বলতে চায় না। কিন্তু শরীর বলে দেয়।
আয়না বলল, আপনি বুদ্ধিমান।
মিসির আলি বললেন, আমার বুদ্ধি আর দশজন মানুষের মতই। আমার সুবিধা হচ্ছে। আমি বুদ্ধি ব্যবহার করি। অন্যরা করে না, বা করতে চায় না।
আয়না বলল, আপনি কি আপনার ছাত্রের লেখা ডায়েরিটা পড়ে শেষ করেছেন?
দশ পৃষ্ঠার মত পড়েছি। Slow reader, কারণ কি জান? কারণ হচ্ছে লেখা থেকে আমি ধরার চেষ্টা করি লেখার বাইরের কি লেখা আছে তা। লেখার মধ্যেও বডি ল্যাংগুয়েজ আছে।
আয়না বলল, যে দশ পৃষ্ঠা পড়েছেন সেখানে লেখার বাইরে কি লেখা আছে?
মিসির আলি বললেন, লেখার বাইরে লেখা আছে যে স্বামী স্ত্রী হিসেবে বাস করেছ কিন্তু তোমাদের ভেতর শারীরিক কোনো সম্পর্ক হয়নি! কি ভাবে ধরলাম বলব?
না। চলুন নাশতা খেতে যাই।
নাশতার টেবিলে হেডমাস্টার সাহেব একটি আনন্দ সংবাদ দিলেন। রাজ্য জয় করে ফেলেছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, ভাই সাহেব গুড নিউজ। গজার মাছ পাওয়া গেছে। ইনশাল্লাহ আজ রাতে আপনাকে ভূত দেখাতে পারব।
মিসির আলি হাসলেন। হেডমাস্টার বললেন, আপনার অবিশ্বাস আজ পুরোপুরি দূর হবে।
মিসির আলি বললেন, অবিশ্বাসী মানুষের সবচে বড় সমস্যা হল একটা অবিশ্বাস দূর হলে অন্য অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়।
আজ সব ভেঙেচুড়ে দেব। খড়ের আগুনে সামান্য লবণ দিয়ে গজার মাছ পুড়া হবে।
মিসির আলি বললেন, সেই মাছ কি আমরা জঙ্গলে রেখে আসব?
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, না। মাছ ঘরে রেখে দেব। তারপর দেখবেন কি হয়।
কি হবার সম্ভাবনা?
পোড়া মাছের লোভে ভূত প্রেতি বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করবে।
আয়না বলল, বাবা ভূতের আলাপ থাকুক। দিনের বেলা ভূতের ইতিহাস শুনতে ভাল লাগে না। সন্ধ্যা হোক তারপর শুরু করা। নাশতা খাবার পর আমি স্যারকে নিয়ে বেড়াতে বের হব। তুমি কি যাবে আমাদের সঙ্গে?
আরো পাগল হয়েছিস? গজার মাছ পুড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে না? মাছ পুড়ানোর টেকনিক আছে। আগুনে ফেলে দিলেই হয় না।
আয়না মিসির আলিকে নিয়ে বটগাছের কাছে এল। সে কাঁধে বুলিয়ে পাটের ব্যাগ এনেছে। সেখান থেকে ক্যামেরা বের করে বলল, বটগাছের ছবি তুলতে চেয়েছিলেন। ছবি তুলুন।
মিসির আলি হাতে ক্যামেরা নিলেন। একবারও জানতে চাইলেন না তিনি যে ছবি তুলতে চেয়েছেন সেটা আয়না জানল কি ভাবে।
মাছরাঙার ছবি তুলুন।
মিসির আলি মাছরাঙার ছবি তুলে বললেন, তোমার একটা ছবি কি তুলে দেব?
আয়না না সূচক মাথা নাড়ল। মিসির আলি বললেন, তুমি এখন মুখের ভাষায় না বলনি। শরীরের ভাষায় মাথা নেড়ে না বলেছ। শরীরের এই ভাষাটা আমরা সবাই জানি। এই ভাষার উৎপত্তি কি ভাবে জান?
জানি না।
জানতে চাও?
চাই।
মিসির আলি বললেন, না বলার এই শারীরিক ভাষা তৈরি হয়েছে আমাদের শৈশবে। একটা শিশুকে মা খাওয়াচ্ছে। সে কথা বলা শিখেনি। তার পেট ভর্তি হয়ে গেছে সে এবার খাবে না। তখন তার মুখের কাছে খাবার নিলে সে মুখ সরিয়ে নেবে।। যেখানে মুখ সরিয়েছে সেখানে খাবার নিলে মুখ আরেক দিকে সরাবে। না সূচক মাথা নাড়ানাড়ি চলতেই থাকবে। বুঝতে পারছ?
আমি যে তোমাকে ইচ্ছা করে অবাক করতে চাচ্ছি সেটা বুঝতে পারছ?
পারছি।
কেন তোমাকে অবাক করতে চাচ্ছি সেটা বুঝতে পারিছ?
বুঝতে পারছি না। এবং বুঝতে চাচ্ছিও না। স্যার আপনি আর কতদিন থাকবেন?
পরশু চলে যাব।
যে মিশন নিয়ে এসেছিলেন সেটা কমপ্লিট হয়েছে?
মোটামুটি হয়েছে।
আয়না মেয়েটির রহস্য ধরে ফেলেছেন?
অনেকখানি ধরেছি। তুমি নিজে তোমার সম্পর্কে যা লিখেছি তা যদি পড়তে দাও। তাহলে পুরোটাই বুঝতে পারব। দিবে?
আয়না স্পষ্ট গলায় বলল, না।
মিসির আলি বললেন, চল বসি।
আয়না। ক্লান্ত গলায় বলল, চলুন।
দু’জন চুপচাপ বসা। মিসির আলি নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন।
আয়না দুঃখী দুঃখী ভঙ্গিতে মিসির আলির দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মিসির আলি বললেন, চুপচাপ বসে না থেকে গল্প কর।
আয়না বলল, আপনি গল্প করুন। আমি শুনি।
কি গল্প শুনতে চাও?
আয়না বলল, আপনার ছাত্রের কাছে শুনেছি আপনার একটা ফাইল আছে, সেখানে যে সব রহস্যের আপনি কোনো মীমাংসা করতে পারেন নি। সেই সব অমীমাংসিত রহস্যের কথা লেখা।
ঠিকই শুনেছ।
সে সব গল্পের একটা শুনান। আপনার ব্যর্থতার গল্প শুনি। না কি আপনার আপত্তি আছে?
কোনো আপত্তি নেই। বরং আগ্ৰহ আছে। আমি রহস্যভেদ করতে পারি নি, অন্য একজন পারবে। সেই অন্য একজন তুমিও হতে পার।
গল্প শুরু করুন।
মিসির আলি শুরু করলেন—
বছর পনেরো আগের কথা। আমার কাছে একটা কিশোরী মেয়ে এসেছে। চৌদ্দ পনেরো বছর বয়স। সে এক আসেনি, তার মা তাকে নিয়ে এসেছে। মেয়েটার নাম নোশিন। তার নাকি ভয়ংকর এক সমস্যা। আমি তার সমস্যার সমাধান দেব এই মা মেয়ে দু’জনের আশা।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি। আমার নিজের একটা ছোট্ট কামরা আছে। ক্লাসের শেষে সেখানে বসে পড়াশোনা করি। মেয়ে এবং মেয়ের মা সেখানেই বসেছে। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, কি সমস্যা গো মা?
মেয়ে ভীত চোখে মা’র দিকে তাকাল। সে তার সমস্যা নিজের মুখে বলতে চায় না। মাকে দিয়ে বলতে চায়। তার মা বললেন, নোশিন কি যেন দেখে।