মিসির আলিকে ডায়েরি পড়া বন্ধ রাখতে হল। কারণ ঘরের ভেতর খটাস খটাস শব্দ হচ্ছে। কে যেন ক্যারাম খেলছে। মাজেদের নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। সে খেলছে না এটা বুঝা যায়। তাহলে কে? মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কদম ফুলের গন্ধ না। কড়া গন্ধ।
মিসির আলি ইচ্ছা করলেই উঁচু হয়ে খাটের ওপাশে কি হচ্ছে তা দেখতে পারেন। তিনি তা করলেন না। ডায়েরি বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। খটাস খটাস শব্দ হতেই থাকল। মিসির আলি চোখ বন্ধ করলেন। খটাস খটাস শব্দ থেমে গেল। কড়া মিষ্টি গন্ধটাও আর পাওয়া যাচ্ছে না। মিসির আলি ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর তৃপ্তির ঘুম হল।
মিসির আলি বারান্দায় বসে আছেন
সকাল আটটা।
মিসির আলি বারান্দায় বসে আছেন। তাঁর পায়ের কাছে মাজেদ। ঘুম ভাঙার পর থেকেই সে মিসির আলির সেবা করার নানান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো লাভ হচ্ছে না। মিসির আলি সেবা গ্ৰহণ করতে রাজি হচ্ছেন। না! মাজেদ হাল ছাড়ার পাত্র না। সে চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে।
পায়ে তেল দিয়া দিমু স্যার?
না।
শীতকালে পায়ে তেল দিতে হয়। তেল না দিলে চামড়া ফাটে।
ফাটুক।
মাথা মালিশ করব? আরাম পাইবেন।
আমার আরামের দরকার নেই।
সবের আরাম দরকার। নেড়ি কুত্তারও আরাম দরকার।
তাই নাকি?
জে। দেহেন না রইদ উঠলে কুত্তা কেমন রইদ তাপায়।
তা ঠিক।
গরুরাও আরাম দরকার। গরুর গলাতে যদি আপনে হাতাহাতি করেন আরামে তার চউখ বন্ধ হয়। মাথা টিপ্যা। আমি আপনেরে এমন আরাম দিব যে আপনের চউখ বন্ধ হয়ে যাবে।
মিসির আলি বললেন, আমি চোখ খোলা রাখতে চাই। বই পড়ছিতো। চোখ বন্ধ রাখলেতো বই পড়তে পারব না। তাছাড়া আমি গরু না, মানুষ।
মাজেদ বলল, কি বই পড়েন?
কবিতার বই পড়ি। দিনের শুরুটা কবিতায় করা ভাল।
কবিতার মধ্যে কি লেখা স্যার?
শুনতে ইচ্ছা করে?
জ্বে।
মিসির আলি আবৃত্তি করলেন—
Two Toads diverged in a yellow wood,
And sorry I could not travel both
And be one traveler, long I stood
And looked down one as far as I could
To where it bent in the undergrowth,
মাজেদ হা করে কবিতা শুনছে। তার চোখ ভর্তি বিস্ময়। মিসির আলি বললেন, কবিতা কেমন শুনলি? ভাল লেগেছে?
জ্বে স্যার। ভাল। আরো শুনবি?
জ্বে শুনব। মাজেদকে কবিতা শুনানো হল না। চা নিয়ে আয়না আসছে। আয়নাকে দেখেই মাজেদ উঠে দাঁড়াল, ভীত গলায় বলল, আমি যাই স্যার পরে আসব। মিসির আলির মনে হল যে কোনো কারণেই হোক মাজেদ আয়না মেয়েটাকে ভয় পায়।
আয়না বলল, চা নিয়ে এসেছি।
মিসির আলি বললেন, থ্যাংক য়ু।
আয়না বলল, আপনার নাশতা রেডি হচ্ছে। খাটি ঘিয়ে ভাজা চপচপে পরোটা এবং রাজহাঁসের ভুনা মাংস। এত চেষ্টা করেও রাজহাঁসের হাত থেকে রক্ষা পেলেন না।
মিসির আলি বললেন, তাইতে দেখছি।
আয়না বলল, স্যার আপনার সামনে বসি।
মিসির আলি বললেন, আরাম করে বাস। এবং কি বলতে চাও বলে ফেল।
আয়না বসতে বসতে বলল, আপনার মানসিক ক্ষমতা দেখে অবাক হয়েছি।
মিসির আলি বললেন, কোন ক্ষমতাটা দেখলে?
আয়না বলল, রাতে ক্যারাম খেলার খটাস খটাস ভৌতিক শব্দ হচ্ছে। আপনি নির্বিকার, মাথা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টাও করলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন। আপনি ছাড়া অন্য যে কোনো মানুষ ভয়ে অস্থির হত। ডাকাডাকি শুরু করত। আপনি একটুও ভয় পাননি, এর কারণ কি স্যার?
মিসির আলি বললেন, বেশির ভাগ মানুষ সংশয়বাদী। তাদের ধারণা ভূত-প্ৰেত থাকলে থাকতেও পারে। আমার মধ্যে এই ধরনের কোনো সংশয় নেই।
ক্যারাম খেলার শব্দ কি ভাবে হল?
মিসির আলি বললেন, শব্দটা পাশের ঘরে হয়েছে। কেউ একজন খটাস খটাস শব্দে ক্যারাম খেলেছে।
সেই কেউ টা কে? আমি?
না তুমি না। তোমার বাবা।
কিভাবে বুঝলেন?
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, তোমার বাবা আমাকে আস্তিক বানানোর চেষ্টা করছেন। পাশের ঘরে খটাস খটাস শব্দ করে আমাকে ভূতের ভয় দেখাতে চাচ্ছেন।
বাবা এই কাজটা করেছেন। আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কি ভাবে?
মিসির আলি বললেন, সকালে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন, রাতে ঘুম ভাল হয়েছে কি না। তার গলায় ছিল কৌতূহল এবং অগ্রহ।
আয়না বলল, এই থেকে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না। আপনি অসুস্থ ছিলেন। অতিথি মানুষ। আপনার ভাল ঘুম হয়েছে কি না সেটা কৌতূহল এবং আগ্রহ নিয়ে জানতে চাওয়াটাতো স্বাভাবিক।
মিসির আলি বললেন, যখন ক্যারাম খেলার শব্দ হচ্ছে তখন আমি মিষ্টি গন্ধ পেলাম। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ার পর খটাস খটাস শব্দ থেমে গেল। মিষ্টি গন্ধও পাওয়া গেল না। মিষ্টি গন্ধটা জর্দার। তোমার বাবা প্রচুর জর্দা দিয়ে পান খান। এখন কি তুমি আমার Deduction গ্রহণ করবে?
জ্বি স্যার করব।
মিসির আলি বললেন, বিডি ল্যাংগুয়েজের একটা ব্যাপার আছে সেটা কি জান?
না।
আমরা মুখে অনেক কথা বলি না, কিন্তু আমাদের শরীর বলে। মনের ভেতরের কথা শরীর প্রকাশ করে দেয়। সকালবেলা তোমার বাবার বডি ল্যাংগুয়েজ তাকে প্রকাশ করে দিয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বুঝাব?
বুঝান।
তুমি আমার সামনের চেয়ারে বসেছি। পায়ের উপর পা তুলে বসেছি। পা কিন্তু আমার দিকে না। যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে রাখা এর অর্থ তুমি আমার সামনে বসে থাকতে চাচ্ছ না, চলে যেতে চাচ্ছ।
আয়না অবাক হল। ভালই অবাক হল।
মিসির আলি বললেন, তুমি এখন তোমার বসার অবস্থা একটু বদলেছ। মাথা সামান্য নিচু করে উপরের দিকে তাকাচ্ছ। মাথা নিচু করে যখন কোনো মেয়ে উপরের দিকে তাকায়, তখন তার চোখ বড় দেখা যায় এবং তার মধ্যে সামান্য হলেও খুকি ভাব আসে। তুমি এই ভাবটা নিয়ে এসে আমাকে বলার চেষ্টা করছি যে আমি যা বলছি তা সত্যি। আরো উদাহরণ