ঘরে এসে সায়রা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আল্লাহগো, তুমি আমাকে আর কত দুঃখ দেবে? আমি যে সহ্য করতে পারছি না। তারপর নিজের ও ছেলের কাপড় চোপড় জমা করে একটা পুঁটলি বাঁধতে লাগল।
হালিম সাত আট বছরের ছেলে। সবকিছু বুঝতে না পারলেও একটু একটু বুঝে। কিছুদিন আগে পাড়ার সমবসয়ী রজবের সঙ্গে যখন খেলা করছিল তখন রজবের বড় ভাই তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোর মা যখন মাতব্বরের ধো*ন কেটে নেয় তখন তুই কোথায় ছিলি?
ধো*ন কি জিনিস হালিম জানে। তাই লজ্জা পেয়ে কিছু না বলে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিল। আসার সময় তার মনে হয়েছিল, তাই বুঝি সেদিন মায়ের কাপড়ে, বিছানায় ও ঘরের মেঝেয় অত রক্ত দেখেছে।
আজ বিচারে গিয়ে বুঝতে পেরেছে মাতব্বর ফজলু চাচার সঙ্গে মায়ের বিয়ে দিতে চায়। ঘরে এসে মাকে কাঁদতে দেখে বলল, এখন কি হবে মা? তুমি কি ফজলু চাচাকে বিয়ে করবে? ও ল্যাংড়া। সবাই ল্যাংরা চামচিকা বলে। ওকে আমি বাবা বলতে পারব না। আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাই চল মা।
ততক্ষণ সায়রার পুঁটলি বাঁধা হয়ে গেছে। চোখ মুছে বলল, ঐ ল্যাংড়া চামচিকাকে বিয়ে করার চেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরাও ভালো।
হালিম মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি মরে গেলে আমার কি হবে! কাকে আমি মা বলে ডাকব?
সায়রা পুঁটলিটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে হালিমের হাত ধরে বলল, তোর জন্যই তো মরতে পারছি না। নচেৎ কবেই গলায় দড়ি দিতাম। তারপর হাঁটতে শুরু করে বলল, আমরা অনেক দূরে এমন জায়গায় যাব, যেখানে মাতব্বরের মতো বদমাইশ লোক নেই। সেখানে লোকের ঘরে ঘরে কাজ করে তোকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করব। তুই মানুষ হয়ে একদিন এই গ্রামে ফিরে এসে মাতব্বরকে শায়েস্তা করে তোর মায়ের উপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিবি।
হালিম বলল, তুমি দেখে নিও মা। আমি বড় হয়ে তোমার কথা মতো সবকিছু করব।
পরের দিন সকালে ফজলুকে আসতে দেখে মাতব্বর বললেন, কিরে ফজলু, সায়রাকে বিয়ে করার জন্য মন বুঝি আর তর সইছে না? এত সকালেই এসে পড়েছিস দেখছি?
ফজলু স্লান মুখে বলল, কাকে বিয়ে করব? সায়রাতো কাল রাতেই ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে।
বিচার শুরুর আগে মাতব্বর ইমাম সাহেবকে বলেছিলেন, আমার লোকেরা পাথর মেরে মেরে ফেলার কথা বলবে। গ্রামের লোকজন যদি আপত্তি না করে তা হলে সায়রাকে ঐ শাস্তি দেয়ার কথা বলবেন। ফজলুকে বাঁচাবার ব্যবস্থা আমি করব। আর গ্রামের লোকজন যদি আপত্তি করে, তা হলে ওদের বিয়ে দেয়ার কথা বলবেন। তাই আবু তাহেরের কথা শুনে ইমাম সাহেব ওদের বিয়ে দেয়ার কথা বলছেন। মাতব্বরের দৃঢ় ধারণা ছিল, সায়রা কিছুতেই ফজলুকে বিয়ে করবে না। রাতের মধ্যে হয় বিষ খাবে, নচেৎ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করবে।
এখন ফজলুর কথা শুনে মাতব্বরের মনে হল, সায়রা যেন তার গালে পায়ের জুতো খুলে মেরে খিলখিল করে হেসে বলছে, লম্পট মাতব্বর, সেদিন তোর পুরুষাঙ্গ কেটেছি, আর আজ তোর গালে মুতে দিয়ে চলে গেলাম।
এইসব মনে হতে মাতব্বর রেগে লাল হয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। বড় বড় চোখ বের করে ফজলুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
তাই দেখে ফজলু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, এতে আমার কি দোষ? ঐ শালী রাতের বেলা পালিয়ে যাবে জানলে সারারাত ওর ঘর পাহারা দিতাম।
মাতব্বর রাগের সঙ্গে বললেন, তুই এখান থেকে দূর হয়ে যা।
তার উপর মাতব্বর রেগে গেল কেন ফজলু বুঝতে পারল না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল।
এমন সময় করিম সেখের বড় ছেলে আসগর এসে বলল, চাচা শুনেছেন, সায়রা ছেলেকে নিয়ে রাতেই পালিয়ে গেছে?
মাতব্বরের রাগ তখনও পড়ে নি। গম্ভীর স্বরে বললেন, পালিয়ে যাবে কোথায়? যেখানেই যাক না কেন, ধরে এনে কি করি সবাই দেখবে। ওকে ধরে আনার জন্য লোক লাগাচ্ছি, তুমিও তাই কর।
আসগর বলল, আপনি না বললেও ওকে খোঁজার ব্যবস্থা করতাম। এই কথা বলে চলে গেল।
মাতব্বর চামচাদের দ্বারা সায়রাকে ধরে আনার জন্য খোঁজ করলেও তার নাম গন্ধও পেল না। শেষে মাতব্বর মঈন সেখের বাস্তুভিটে দখল করে ফলের বাগান করলেন।
.
সে সব বিশ বাইশ বছর আগের কথা। এখন মাতব্বর বুড়ো হয়ে গেছেন। তার একমাত্র ছেলে রশিদের বিয়ে দিয়েছেন। দু’তিনটে পোতা-পুতিনের দাদা হয়েছেন। রশিদ পুরো বাপের চরিত্র পেয়েছে। কোনো মেয়ে চোখে ধরলে তাকে যেমন করে তোক ভোগ করবেই। মাতব্বর ছেলের দুশ্চরিত্রের কথা জেনেও নিজের কথা ভেবে তাকে কিছু বলতে পারেন না। টাকা পয়সা দিয়ে ছেলের অপকর্ম চাপা দেয়ার চেষ্টা করেন।
আজ কয়েকজন লোক রক্তাক্ত রসিদকে ধরাধরি করে তাদের বৈঠকখানায় নিয়ে এলে মাতব্বর ছেলের অবস্থা দেখে হায় হায় করে উঠে বললেন, কোন হারামির বাচ্চা এমন কাজ করল?
লোকজনের মধ্যে মাতব্বরের চাকর জয়নুদ্দিন বলল, আমি গাভীর জন্য বাগানের পুকুর পাড়ে ঘাস কাটতে গিয়ে ওনাকে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে লোকজন ডেকে নিয়ে এলাম।
মাতব্বর তাড়াতাড়ি রসিদকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে নিজেও সঙ্গে গেলেন। থানার পাশ থেকে হাসপাতাল যাওয়ার পথ। তাই মাতব্বর ভাবলেন, প্রথমে থানায় গিয়ে ছেলেকে দেখিয়ে কেস করবেন। তারপর হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
দারোগা আলি হোসেনের সঙ্গে মাতব্বরের খুব খাতির। পুকুরের বড় মাছ, বাগানের ফল পাকাড়ী ও তরীতরকারী পাঠিয়ে দেন। তাছাড়াও ঈদ বকরীঈদে টাকা পয়সাও দেন। তাই বাহেরচর গ্রামের কোনো ব্যাপারেই দারোগা নাক গলান না। কেউ কোনো ব্যাপারে থানায় কেস করতে গেলে কেস না নিয়ে মাতব্বরের কাছে পাঠিয়ে দেন।