হাজেরা মেয়েকে কাঁদতে কাঁদতে খালি হাতে ফিরে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?
সাফিয়া চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঘটনাটা বলে বলল, বুড়ো লোকটা এসে না রক্ষা করলে আমাকে গলায় দড়ি দিতে হত।
হাজেরা বলল, আল্লাহ বুড়ো লোকটার ভালো করুক। তারপর আবার বলল, রশিদ বুড়োটাকে কিছু বলে নি?
তা আমি কি করে বলব? উনি রশিদের ঘাড় এমন জোরে ধরেছিল, রশিদ নড়াচড়া করতে পারে নি। জান মা, লোকটাকে দেখে মনে হল, যেন ফেরেস্তা। লম্বা চওড়া, মুখ ভর্তি দাড়ি, ফরসা টকটকে দেখতে কি সুন্দর। আমাকে বলল, তুমি ঘরে চলে যাও, এ আর কোনোদিন তোমার দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।
হাজেরা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, এরকম লোকতো এ তল্লাটে কখনও দেখি নি। মনে হয়, দূরের অন্য কোনো গ্রামের মানুষ ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল।
সন্ধ্যাবেলা দবির ফিরে এলে হাজেরা স্বামীকে ঘটনাটা জানাল।
শুনে দবির খুব রেগে উঠে বলল, ওকে বাইরে পাঠাতে তোমাকে নিষেধ করেছি না? আর কনোদিন পাঠাবে না। তারপর মেয়েকে রাগারাগি করে বলল, তোকেও তো বাইরে যেতে নিষেধ করেছি। তবু গেলি কেন?
হাজেরা বলল, ও তো বাইরে যেতে চায় নি। আমিই জোর করে পাঠিয়েছি।
রাতে খাওয়ার পর ছোট ভাই-বোনেরা ঘুমিয়ে পড়লেও সাফিয়ার চোখে ঘুম নেই। সে দুপুরের ঘটনাটা ভাবছিল, বুড়ো লোকটা কে হতে পারে? মা বলল, এ তল্লাটে ওরকম লোক নেই। তা হলে আল্লাহ কি কোনো ফেরেস্তাকে পাঠিয়েছিল। আমার ইজ্জত রক্ষা করার জন্য।
দবির ও হাজেরার চোখেও ঘুম নেই। এক সময় দবির স্ত্রীকে বলল, রশিদের চোখে যখন সাফিয়া পড়েছে তখন আজ রক্ষা পেলেও পরে পাবে না। ওকে স্বামীর ঘরে পাঠিয়ে দেয়াই ভালো।
হাজেরা বলল, সে কথা আমিও ভাবছি। কিন্তু বাকি তিন হাজার টাকাটা না দিলে সাফিয়া কি যেতে চাইবে? না ওকে পাঠান ঠিক হবে? জামাই তো বলেই দিয়েছে, টাকা না নিয়ে এলে তালাক দিয়ে ফেরৎ পাঠিয়ে দেবে।
দবির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
হাজেরা বলল, কিছু বলছ না যে?
দবির আবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ওর জন্য খুব চিন্তা হয়। জানি ওর ভাগ্যে কি আছে।
এমন সময় শুনতে পেল, বাইরে থেকে কেউ যেন বলছে, দবির ভাই কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?
অচেনা গলা শুনে ভয়ে তাদের গলা শুকিয়ে গেল। দবির ও হাজেরা একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
আবার শুনতে পেল, দবির ভাই, একটু বাইরে আসুন, কথা আছে।
স্বামী কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হাজেরা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিস ফিস করে বলল, নিশ্চয় রশিদের লোক। কথা বলো না, চুপ করে থাক।
রশিদ বৌ-এর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, কে তুমি?
নাম বললে আমাকে চিনবেন না। কোনো ভয় নেই। বাইরে আসুন।
এত রাতে এসেছ কেন? যা বলার দিনে এসে বলো।
দিনে আসতে পারব না। আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আপনার ভালোর জন্যই এসেছি। দু’একটা কথা বলেই চলে যাব।
লোকটা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে শুনে রশিদ বৌকে বলল, রশিদের লোক হলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে কি করে? মনে হয় ভিন গাঁয়ের লোক।
একটা ঘরের মধ্যেই সাফিয়া ভাইবোনের নিয়ে অন্য বিছানায় ঘুমায়। সেও লোকটার কথা শুনেছে। উঠে এসে মা বাবাকে অনুচ্চ স্বরে বলল, মনে হয় সেই বুড়ো লোকটা এসেছে।
দবির বলল, তোর একথা মনে হল কেন?
এই লোকের গলা ঠিক সেই বুড়ো লোকটার মতো।
কি হল ভাই আল্লাহর কসম কেটে বললাম, তবু বিশ্বাস হচ্ছে না?
দবির আর দেরি করল না। হারিকেনের পলতে বাড়িয়ে হাতে করে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
লোকটা এগিয়ে এসে সালাম দিল।
দবির সালামের উত্তর দিয়ে হারিকেন উঁচু করে বলল, কে আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
দরজার আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে সাফিয়া তাকে দেখে ঠিক চিনতে পারল। গলা একই রকম হলেও এর দাড়ি ছোট ও কালো। সে লোকটার দাড়ি ছিল খুব লম্বা ও ধবধবে সাদা। তবে মুখটা যেন একইরকম মনে হল। ভাবল, তখন হয়তো ভুল দেখেছিলাম। তাই বাবার কাছে এসে বলল, উনিই আমাকে মাতব্বরের ছেলের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
মেয়ের কথা শুনে দবিরের ভয় কেটে গেল। বলল, একটা পাটি এনে বিছিয়ে দে।
সাফিয়া ঘর থেকে একটা পাটি এনে বিছিয়ে দিতে দবিরর বলল, আপনি বসুন।
লোকটা বসে বলল, আপনিও বসুন। দু’চারটে কথা জিজ্ঞেস করব।
দবির বলল, আপনার পরিচয় আগে বলুন।
আমাকে আপনি করে বলবেন না। আমি আপনার চেয়ে বয়সে ছোট। আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। যা বলছি শুনুন, তারপর সাফিয়াকে দেখিয়ে বলল, ওর জন্য কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। মনে হয়, মাতব্বরের ছেলের কি অবস্থা। হয়েছে তা আপনারা শোনেন নি। যে বুড়ো লোকটা আপনার মেয়ের ইজ্জৎ বাঁচিয়েছেন, তিনি মাতব্বরের ছেলের একটা হাত কেটে দিয়েছেন আর একটা চোখ তুলে নিয়েছেন। সে আর কোনো দিন কোনো মেয়ের দিকে নজর দেবে না। আমার কথা সত্য না মিথ্যা খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন।
দবির মনে মনে খুশী হয়ে বলল, তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে ভিন গাঁয়ের লোক। একথা তুমি জানলে কি করে? আর এত রাতেই বা আমাদের কথাটা জানাতে এসেছ কেন?
আমি সে সময় ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনার মেয়ের আর্তচিৎকার শুনে বাগানের ভিতর তাকাতে দেখতে গেলাম, মাতব্বরের ছেলে আপনার মেয়ের শালীনতাহানীর চেষ্টা করছে। পরক্ষণে দেখলাম, একটা বুড়োলোক মাতব্বরের ছেলের ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে আপনার মেয়েকে চলে যেতে বললেন। আপনার মেয়ে চলে যাওয়ার পর বুড়ো লোকটা মাতব্বরের ছেলের প্রথমে একটা হাত কেটে দিল। তারপর তার একটা চোখ তুলে নিল।