হাবিব ডাক্তার বললেন, যারা বেশি ধার্মিক তাদেরকে আল্লাহ কঠিন কঠিন বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। এর বেশি কিছু বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। আজ আর নয়, চলুন, আপনার চাচাকে দেখে তারপর যাব।
আজরাফ হোসেন একটু উঁচু গলায় বললেন, যীনাত, এদিকে একটু আয় তো বোন।
যীনাত রান্না করছিল। ভাইয়ার কথা শুনে এসে একপাশে দাঁড়াল।
আজরাফ হোসেন বললেন, চাচাকে ডাক্তার দেখবেন। তুই ঘরে যা। আমরা আসছি।
হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে পরীক্ষা করে বলল, আজরাফ স্যারের কাছে আপনার সব কথা শুনেছি। আমার যতদূর বিশ্বাস আপনি মানসিক দিক দিয়ে খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। আর মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করেন। অবশ্য এরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তবু বলব আপনি ধার্মিক লোক হয়ে এতটা ভেঙ্গে পড়া ঠিক হয় নি। জানেন তো, সবকিছু আল্লাহর মর্জিতেই হয়। তাঁর মর্জির উপর সন্তুষ্ট থাকা মুমীন মুসলমানদের কর্তব্য। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের কঠিন কঠিন বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। নবী হযরত আইয়ুব (আঃ) এর কথা জানেন বোধহয়? তাকে আঠার বছর কুষ্ঠ রোগ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। শুধু তাই নয় তাঁর বাণিজ্যিক জাহাজগুলো ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের মৃত্যু দিয়েছিলেন। শেষে বাড়ি ছাড়া করে জঙ্গলে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতকিছু সত্ত্বেও হযরত আইয়ুব (আঃ) আল্লাহর উপর এতটুকু অসন্তুষ্ট হন নি। বরং সব সময় তার জিকিরে মশগুল থাকতেন। তিনি পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। তাই আল্লাহ তাকে ব্যাধিমুক্ত করেন এবং ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দেন ও ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়ে দেন। আমি আপনার চিকিৎসা করব। আপনি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে বুকে সাহস রাখুন। তার কাছে গুনাহ খাতা মাফ চেয়ে রোগ মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করুন। আর সবর করার তওফিক চান। ইনশাআল্লাহ। আপনি কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠবেন। আর আপনার মেয়ের জন্য এতটুকু দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহ প্রত্যেকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। কোনো মানুষই তা পরিবর্তন করতে পারবে না। একথা আপনি জেনেও কেন তার জন্য এত দুশ্চিন্তা করেন? আমি মাঝে মাঝে আপনাকে দেখতে আসব। আজই ওষুধ পাঠিয়ে দেব। খাওয়ার নিয়ম কাগজে লিখে দেব। ঠিকমতো ওষুধগুলো খাবেন। তারপর আজরাফ হোসেনকে বলল, কাউকে পাঠাবেন, তার হাতে ওষুধগুলো দিয়ে দেব।
আজরাফ হোসেন বললেন, আপনাকে ওষুধ পাঠাতে হবে না। আপনি প্রেসক্রিপশন করে দিন, আমি কিনে নেব।
হাবিব ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে বলল, ওষুধগুলো এখানে পাবেন কিনা জানি না, যদি না পান, ঐ লোককে আমার কাছে যেতে বলবেন। তারপর যীনাতের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা বোতলে পানি ভরে নিয়ে আসুন।
যীনাত বোতলে পানি ভরে নিয়ে এলে আজরাফ হোসেনকে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনি ওকে নিয়ে ঘরে চলে যান। আমি ইনার সঙ্গে কিছু আলাপ করে চলে যাব।
আজরাফ হোসেন একটু অবাক হলেও কিছু না বলে যীনাতকে নিয়ে চলে গেলেন।
হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে জিজ্ঞেস করল, প্রায় প্রতিরাতে আপনার স্ত্রীকে স্বপ্নে দেখেন তাই না?
হাশেম আলি অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ দেখি।
কি অবস্থায় ওঁকে দেখেন?
আমি যেন এই খাটে শুয়ে আছি, আর আমার স্ত্রী ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করি, কাঁদছ কেন? কোনো উত্তর না দিয়ে কাঁদতেই থাকে। কাছে আসতে বললেও আসে না।
আমি খাট থেকে নেমে কাছে গেলে তাকে আর দেখতে পাই না।
প্রায় প্রতি রাতে একই স্বপ্ন দেখেন তাই না?
হ্যাঁ তাই।
হাবিব ডাক্তার বিড় বিড় করে কিছু পড়ে হাশেম আলির গায়ে ও বোতলের মুখে ফু দিল। তারপর বলল, সকালে ও সন্ধের পর বোতলের পানি এক ঢোক করে খাবেন। আর রাতে ঘুমাবার সময় হাতে অল্প একটু পানি নিয়ে চোখে মুখে দেবেন। তা হলে স্বপ্নে আর আপনার স্ত্রীকে দেখবেন না। আবার বলছি, যীনাতের ব্যাপারে কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আপনি কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় পাত্র নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেবে। এবার আসি, কয়েকদিন পর আসব। আর শুনুন, এসব কথা কাউকে বলবেন না। এমন কি আজরাফ স্যার বা আপনার মেয়েকেও না। কথাটা খুব খেয়াল রাখবেন বলে হাবিব ডাক্তার সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
কয়েক মাসের মধ্যে হাশেম আলি সম্পূর্ণ না হলেও বেশ কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। হাঁটাচলা করতে পারেন। পাড়ার পাঞ্জেগানা মসজিদে নামায পড়তে যেতে পারেন। জুম্মা মসজিদ বিশ্বাস পাড়ায়। দূর বলে জুম্মা পড়তে যেতে পারেন না। হাবিব ডাক্তারের চিকিৎসায় পঙ্গু হাশেম আলি চলাফেরা করতে পারে জানার পর সারা গ্রামের মানুষের কাছে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
আজরাফ হোসেন গ্রামের সবার মতো তাকে একজন ভালো ডাক্তার ও কামেল নোক মনে করেন। তার অনুরোধে হাবিব ডাক্তার প্রতি মাসে একদিন এসে তাসনিমা খাতুনকে চেকআপ করে। সেই সাথে হাশেম আলিকেও করে।
হাবিব ডাক্তারের সব কিছু দেখে শুনে যীনাত মুগ্ধ। বর্তমান যুগে এরকম মানুষও থাকতে পারে, তা তাকে না দেখলে বিশ্বাস করত না। চব্বিশ-ঘণ্টা তার কথা ভাবে। আব্বাকে দেখতে এলে যতটুকু পারে ভালো আপ্যায়ন করাবার চেষ্টা করে। সে সময় একে অপরের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। তার সম্পূর্ণ পরিচয় জানার খুব ইচ্ছা হয় যীনাতের। ইচ্ছাটাকে জোর করে দমন করে রাখে।