এবার চামচে না খেয়ে হাতে খাওয়ার ব্যাপারে বলছি। রাসূল (দঃ) কখনও চামচে খান নাই, হাতে খেয়েছেন। আমি তাকে অনুসরণ করেছি মাত্র। এটা তখনই গোঁড়া হত যদি আপনাকেও হাতে খাওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করতাম। আপনি জানেন কিনা জানি না, ইসলামে কিন্তু জোর জবরদস্তির স্থান নেই।
আজরাফ হোসেন বললেন, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দোষ কোথায় বলুন? মৌলবীরা শুধু সওয়াব হাসিল করার জন্য কুরআন-হাদিস থেকে বয়ান করেন। তারা যদি আপনার মতো সওয়াবের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক যুক্তিগুলোও দেখাতেন, তা হলে ইসলামের কোনো কাজকেই মুসলমানরা অবহেলা করত না। এবং যারা ইসলামের অনুসারী তাদেরকে কেউ গোঁড়া বলতে পারত না।
হাবিব ডাক্তার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আপনার কথাই ঠিক। আলেমদের এই ভুলের জন্য সারাবিশ্বে মুসলমানরা আসল ইসলাম থেকে বঞ্চিত হয়ে সওয়াব কামাবার জন্য শুধু খোলস নিয়ে টানাটানি করছে। আর সেইজন্য তারা বিশ্বের কাছে সাম্প্রদায়িক আখ্যা পাচ্ছে। অথচ ইসলামে সাম্প্রদায়িকতার এতটুকু স্থান নেই।
আজরাফ হোসেন বললেন, আপনি খুব দামী কথা বলেছেন। তারপর বললেন, আমি আশ্চর্য হচ্ছি, আপনি একজন ডাক্তার হয়ে ইসলামের এত জ্ঞান অর্জন করলেন কি করে? আপনি তো আর মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রী নেন নি?
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, মাদ্রাসায় না পড়লেও প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। আর সে জন্যে আমাদের স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির সিলেবাসে ইসলামী বই পাঠ্য করা উচিত। এটা করা হয় নি বলেই স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটি থেকে যারা ডিগ্রী নিয়ে বেরোচ্ছে, তারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছে না। তাই ইসলামের প্রতি তারা এত উদাসীন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এবার এসব কথা থাক। আপনার চাচার কথা বলুন, শোনার পর ওঁকে একটু দেখে যাব।
যীনাত এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। এবার ভিতরে ঢুকে নাস্তার প্লেট ও চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল।
আজরাফ হোসেন যীনাতের দিকে তাকিয়েছিলেন। বেরিয়ে যেতে বললেন, জানেন ডাক্তার, একে নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তা। হাশেম চাচা, মানে যীনাতের বাবা ওর দুইবার বিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমবার বিয়ের রাতে জামাই সাপের কামড়ে মারা যায়। বছর খানেক পরে আমি উদ্যেক্তা হয়ে আবার বিয়ে দিলাম। যীনাত দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে রাজি ছিল না। আমিই অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলাম। বৌ নিয়ে বর ও বরযাত্রী ফিরে যাওয়ার সময় পথে ঝড়-বৃষ্টি হয়। সেই সময় বজ্রপাতে ঐ জামাইও মারা যায়। এরপর থেকে ওকে গ্রামের সবাই অপয়া মেয়ে বলে। যীনাতও নিজেকে অপয়া ভাবে। আমি আবার ওর বিয়ে দিতে চাই; কিন্তু কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। আমার স্ত্রীকে বোঝাতে বলেছিলাম, রাজি না হয়ে বলেছে, আমার তকদীরে স্বামী নেই। যদি থাকত, তা হলে দু’দুটো স্বামী বিয়ের রাতে মারা গেল কেন? আবার যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে যদি মারা যায়, তা হলে এ মুখ কাউকে দেখাতে পারব না। এমনই তো সবাই আমাকে অপয়া বলে। অথচ ওর মতো সুন্দরী ও গুণবতী মেয়ে দ্বিতীয় আর কেউ আছে কিনা জানা নেই। চাচী আম্মা, মানে ওর মাও খুব সুন্দরী, গুণবতী, ধার্মিক ও পর্দানশীল ছিলেন। হাশেম চাচা আমার থেকে চার পাঁচ বছরের বড় হলেও আমাদের মধ্যে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। আমি তো সম্পর্কে চাচী আম্মার ছেলে, তবু তিনি আমার সামনে আসতেন না। কথা বললে পর্দা করে বলতেন। গ্রামের কেউ তার পা পর্যন্ত দেখে নি। কোথাও গেলে বোরখা পরে হাতে পায়ে মোজা পরে যেতেন। আমার মা তাকে খুব ভালবাসতেন। মায়ের কাছে রাতে আসতেন। মায়ের কাছে তার সবকিছু শুনেছি। মা বলতেন, হাসেমের বৌ আল্লাহর খাস বান্দি। একটা ঘটনা বলছি শোন, তুই তখন আমার কোলে দু’বছরের। সেই সময় হাসেমের রান্নাঘরে আগুন লাগে। সেখান থেকে তাদের শোবার ঘরের চালে আগুন লাগে। হাশেম আলি ঘরে ছিল না। গ্রামের লোকজন আগুন নেভাতে এসে দেখল, শোবার ঘরের চালের আগুন ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে আগুন নিভে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ফিরে গেল। আশপাশের বাড়ির মেয়েরা হাশেম আলির বৌ-এর খোঁজ করে না পেয়ে ঘরের বন্ধ দরজা আঘাত করে ডাকতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর বৌটা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। মেয়েরা বলল, তোমার ঘরের চালে আগুন লেগেছে আর তুমি দরজা বন্ধ করে ঘরে রয়েছ। এ কেমন কথা? বৌটা চুপ করে রইল। অনেকে ঘরের ভিতর উঁকি মেরে দেখল, নামায পাটি বিছানো রয়েছে। যখন অনেকবার প্রশ্ন করেও উত্তর পেল না তখন তারা ফিরে গেল। কথাটা শুনে কয়েকদিন পর আমি হাশেমের বৌকে ডেকে পাঠালাম। আসার পর ঘটনাটা জিজ্ঞেস করলাম। বলল, ঘরের চালে আগুন লেগেছে দেখে ভাবলাম, লোকজন যখন নেভাতে আসবে তখন আমি পর্দা রক্ষা করতে পারব না, তাই তাড়াতাড়ি অযু করে ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে নামাযপাটি বিছিয়ে সিজদায় গিয়ে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে জানালাম, “আমি বেপর্দার ভয়ে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি আমাকে রক্ষা কর। তোমার ইশারাতেই আগুন লেগেছে। তুমি ইচ্ছা করলে নিভাতে পার। নমরুদ যখন হযরত ইবরাহিম (আঃ) কে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দিয়েছিল তখন তুমি সেই অগ্নিকুণ্ডকে ফুলের বাগান করে দিয়েছিলে। ইচ্ছা করলে তুমি আমাদের ঘরের আগুন নিভিয়ে দিতে পার। অথবা আমাকেসহ এই ঘর পুড়িয়ে দিতে পার। আমি তোমার কাছে নিজেকে সোপর্দ করলাম। আরো অনেক কিছু বলে কান্নাকাটি করতে লাগলাম। তার অপার করুণায় ও কুদরতে ঘরের আগুন আপনা থেকে নিভে যায়।” চাচী আম্মা কিভাবে মারা যান বলছি শুনুন, যীনাতের বয়স তখন দশ কি বার, একদিন রাত তিনটের সময় চাচী আম্মা তাহাজ্জুদের নামায পড়ার সময় সিজদায় গিয়ে মারা যান। তারপর চাচা আর বিয়ে করেন নি। যীনাত মায়ের সবগুণ পেয়েছে। প্রাইমারীতে বৃত্তি পেয়েছিল। চাচী আম্মা আর পড়াতে চান নি। আমিই বুঝিয়ে সুঝিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি করি। এখন যেভাবে ওড়না পরেছে দেখলেন; ক্লাস সিক্স থেকে ঐভাবেই ওড়না পরে স্কুলে যেত। এস.এস.সি.তেও মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে পাশ করেছিল। ওকে দামুড়হুদা ওদুদশাহ কলেজে ভর্তি করতে চেয়েছিলাম। যীনাত রাজি হল না। বলল, বাসে লোকজনের গা ঘেষাঘেষি করে যাতায়াত করতে পারবে না। হাশেম চাচার অবস্থা তখন স্বচ্ছল ছিল। উনিও খুব ধার্মিক। স্ট্রোক করে প্রথমদিকে একু-আধটু চলাফেরা করতে পারতেন। কিছুদিন থেকে তাও পারেন না। উনি বেঁচে থাকতে যীনাতের আবার বিয়ে দিতে চান। আমিও চাই; কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। কথায় আছে, বসে বসে খেলে রাজার ধন ভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায়। হাশেম চাচা জমি-জায়গা বিক্রি করে এতদিন সংসার চালিয়েছেন, নিজের চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন একদম নিঃস্ব। বাস্তুভিটা ছাড়া কিছুই নেই। আমি ওদেরকে যতটা পারি সাহায্য করি। যীনাত সারাদিন আমাদের সংসারে কাজকর্ম করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘরে গিয়ে বাপের সেবা করে। ওরা সবাই এত ধার্মিক, তবু কেন আল্লাহ ওদের উপর এত বিপদ দিলেন বলতে পারেন?