একরাতে আজরাফ হোসেনের ঘুম ভেঙ্গে যেতে স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে বললেন, কী হয়েছে? কাদছ কেন? কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?
তাসনিমা খাতুন চোখ মুছে বললেন, আমি এমনই হতভাগী এতদিনেও তোমাকে একটা সন্তান দিতে পারলাম না।
আজরাফ হোসেন বললেন, তুমি কী সন্তান দেয়ার মালিক? মালিক তো আল্লাহ। তাঁর ইচ্ছায় সারা মাখলুকে সব কিছু চলছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমাদেরকে সন্তান দেবেন। ইচ্ছা না হলে দেবেন না। এতে কাদার কি আছে? শোন, আল্লাহর ইচ্ছার উপর প্রত্যেক মানুষের, বিশেষ করে মুসলমানদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। নচেৎ ঈমান থাকবে না।
তাসনিমা খাতুন বললেন, আল্লাহ আমাদের এত কিছু দিয়েছেন, কিন্তু একটা সন্তান দিচ্ছেন না কেন?
এক্ষুনি বললাম না, সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছা? সেদিন কুরআনের তফসিরে পড়লাম, হযরত ইয়াকুব (আঃ)-কে বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) নামে সন্তান দিয়েছিলেন। তখন তাঁর স্ত্রীর সন্তান ধারণের বয়স পার হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। আমাদের এখনও সন্তান হওয়ার সময় আছে। অত নিরাশ হচ্ছ কেন? ভাগ্যে থাকলে নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের আশা পূরণ করবেন।
চল না, তারানগর ফকিরের দরগায় গিয়ে সন্তানের জন্য মানত করে আসি।
কী বললে? ফকিরের দরগায় মানত করবে? জান না, কোনো পীরের মাজারে বা দরগায় কোনো কিছু মানত করা, সিন্নী, আগরবাতি, মোমবাতি বা টাকা-পয়সা দেয়া হারাম। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে এটা শেরেক। আর শেরেক খুব কঠিন গোনাহ। যা আল্লাহ মাফ করবেন না।
কই, এরকম কথা তো আগে কখনও শুনি নি? কত লোক তো ঐসব জায়গায় গিয়ে মানত করে।
যারা করে, তারা ইসলামের এই হুকুম জানে না। মানত করতে হলে আল্লাহর কাছে করতে হয়। আমি তাঁর কাছে করেছি, তুমিও কর। কোনো মাজারে বা দরগায় মানত করার কথা কখনো মনে আনবে না।
তওবা করছি, আর কখনও মনে করব না। আল্লাহ আমাকে মাফ করুক। তারপর মানত করল, “আল্লাহ আমাদেরকে অন্তত একটা সন্তান দাও। আমি মসজিদে এক হাজার, মাদ্রাসায় এক হাজার টাকা দান করব। আর গ্রামের গরিব এতিম ছেলেমেয়েদেরকে ঈদের সময় এক হাজার টাকার নতুন জামা-কাপড় কিনে দেব।”
আজরাফ হোসেন আমিন বলে বললেন, আল্লাহ তুমি আমার স্ত্রীর মনের কামনা কবুল কর।
মানত করার মাস দুই পর তাসনিমা খাতুন কিছু খেতে পারছেন না। খেতে গেলে ওকি হয়। জোর করে খেলে বমি হয়ে যায়। স্ত্রীর এই রকম অবস্থা দেখে আজরাফ হোসেন একজন কাজের লোককে হাবিব ডাক্তারকে নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়েছিলেন।
হাবিব ডাক্তার তখন মাত্র ছ’মাস হল কার্পাসডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্সে জয়েন করেছে। আজরাফ হোসেনের বাড়িতে এসে সব কিছু শোনার পর রুগীর নাড়ী পরীক্ষা করে মৃদু হেসে বললেন, আপনার স্ত্রীর পেটে সন্তান এসেছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন।
আজরাফ হোসেন আনন্দে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারলেন না। তারপর সামলে নিয়ে উৎফুল্লকণ্ঠে বললেন, সত্যি বলছেন ডাক্তার?
হাবিব ডাক্তার বললেন, জি।
আজরাফ হোসেন ঘরের মেঝেতেই সিজদায় গিয়ে কিছুক্ষণ চোখের পানি ফেলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর সিজদা থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, জানেন ডাক্তার, আজ একযুগ এই খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
হাবিব ডাক্তার অবাক হয়ে বলল, এতদিন তা হলে আপনাদের কোনো সন্তান হয় নি?
তবে আর বললাম কেন, এই খবর শোনার জন্য একযুগ অপেক্ষা করছি।
তাসনিমা খাতুনও ডাক্তারের কথা শুনে ঘোমটার ভিতর চোখের পানি ফেলে আল্লাহর শোকর আদায় করছিলেন। স্বামীর কথা শেষ হতে বললেন, ডাক্তার সাহেবকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসান। এই শুভক্ষণে মিষ্টি মুখ করাবেন।
মিষ্টি ঘরে ছিল, বারান্দায় বসার পর একটা মেয়ে মিষ্টি নিয়ে এসে সালাম দিল।
আজরাফ হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কিরে, এক্ষুনি চলে এলি যে? চাচা আজ কেমন আছেন?
মেয়েটি বলল, একই রকম। তারপর আবার বলল, ভাবির শরীর খারাপ শুনে আব্বা থাকতে দিলেন না। কথা শেষ করে চলে গেল।
মেয়েলী কণ্ঠে সালাম শুনে হাবিব ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে অবাক। শাড়ি পরে থাকলেও ওড়না দিয়ে মাথা ও মুখ ঢেকে রেখেছে। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সেই চোখের দিকে একপলক তাকাতে ডাক্তারের কলজে কেঁপে উঠল। সে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ভুলে গেল আজরাফ হোসেন বসে আছেন। এত মায়াবী চোখ সে জীবনে দেখে নি। তার মনে হল, মেয়েটির চোখে যাদু আছে। তা ছাড়া কোনো মেয়ের গলার স্বর যে এত মিষ্টি, তাও কোনো দিন শোনে নি। মেয়েটি চলে যাওয়ার পর আজরাফ হোসেন যখন বললেন, নিন ডাক্তার, একটু মিষ্টি মুখ করে নিন তখন বাস্তবে ফিরে এল।
মিষ্টির প্লেটে চামচ থাকা সত্ত্বেও হাবিব ডাক্তার জগ নিয়ে বারান্দার কিনারে গিয়ে দু’হাত ধুয়ে এসে বিসমিল্লাহ বলে, খেতে খেতে বলল, আপনার চাচার কি হয়েছে?
আজরাফ হোসেন বললেন, উনি এক রাতে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করে প্রায় দু’বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। চলাফেরাও করতে পারেন না।
হাবিব ডাক্তার বলল, আল্লাহ খায়ের করুক, খুব দুঃখের ব্যাপার। তা চিকিৎসা করান নি?
হ্যাঁ, খুব দুঃখের ব্যাপারই। যীনাত, মানে যে মেয়েটা মিষ্টি নিয়ে এল, ওর জীবনটাও খুব দুঃখের। আর চিকিৎসার কথা যে বললেন, তা করান হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু কোনো ফল হয় নি।