আমি অনেক দিন থেকে একটা সমস্যায় ভুগছি। মা সমস্যাটা জেনে সমাধান করার চেষ্টা করবে বলেছিল। কিন্তু প্রায় দু’বছর হয়ে গেল কিছু করতে পারে নি। মনে হয় কোনো দিন পারবেও না। আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন।
বেশ তো, সমস্যাটা বলুন, সমাধান করার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
আপনাকে ওয়াদা করতে হবে, যা বলব তা কাউকে বলবেন না।
তার কথা শুনে হাবিব ডাক্তার যেমন অবাক হল, তেমনি কৌতূহলবোধও করল। বলল, আপনি নিশ্চিন্তে বলুন, আমি কাউকে বলব না।
আতিকা নাদের আলির সবকিছু ও তাদের দু’জনের সম্পর্কের কথা বলে বলল, আপনার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতেই মনে হয়েছে, আপনি আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
হাবিব ডাক্তার কিছুক্ষণ চিন্তা করে গম্ভীর স্বরে বলল, মাত্র কয়েক মাস হল আমি এই এলাকায় এসেছি। এখানকার সব মানুষের সঙ্গে যেমন পরিচয় হয় নি, তেমনি সামাজিক রীতিনীতিও জানতে পারি নি। আপনার সমস্যার সমাধান করা খুব কঠিন। আমি বাইরের লোক। ডাক্তার হিসাবে সবাই আমাকে চেনে। সামাজিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়া কি আমার উচিত হবে? তা ছাড়া আপনার আব্বাকে যতটুকু জেনেছি, তিনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।
আতিকা দ্রুত হাবিব ডাক্তারকে কদমবুসি করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি যদি আপনার ছোট বোন হতাম, তা হলেও কি কিছু করতেন না?
তার অবস্থা দেখে হাবিব ডাক্তার বুঝতে পারল, পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। উপদেশ দিয়ে ফেরান আর সম্ভব নয়। নেতিবাচক কিছু বললে যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তাই অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে, আপনি এখন বাড়ি যান। আমি কিছুদিন চিন্তা ভাবনা করে সমাধান করার চেষ্টা করব। আপনারা আর দেখা সাক্ষাত করবেন না। যদি করেন, তা হলে কিছু করতে পারব না। একটা কথা সব সময় মনে রাখবেন, “আল্লাহর ইশারা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না।” তিনি যদি আপনাদের জোড়া করে পয়দা করে থাকেন, তা হলে শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও তা করাবেন। নাদের আলির সঙ্গে আমার দেখা হলে তাকেও এসব কথা বলব।
এই ঘটনা দু’তিন মাস আগের। তাই আজ হাবিব ডাক্তারকে আসতে দেখে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কতটা কি করল, জানার জন্য রাস্তায় এসে দেখা করে।
আতিকা যখন হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিল তখন মুশতাক বিশ্বাস সদরে কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। জানালা দিয়ে মেয়েকে হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলতে দেখেছেন। লোকজন চলে যাওয়ার পর চিন্তা করলেন, আতিকা কি হাবিব ডাক্তারকে পছন্দ করে? না নিজের কোনো
০৩. নতুন হেলথ কমপ্লেক্স
কার্পাসডাঙ্গায় বছর দুই হল নতুন হেলথ কমপ্লেক্স হয়েছে। এখানে দু’জন ডাক্তার। একজন হাবিব আর অন্যজন সাগীর। আর দু’জন নার্স ও দু’জন আয়া আছে। প্রথমে সাগীর এখানে জয়েন করে। বন্যার পর হাবিব অফিসার হিসাবে জয়েন করেছে। তারা হেলথ কমপ্লেক্স-এর কোয়ার্টারে থাকে। সাগীরের বয়স প্রায় চল্লিশ। সে ফ্যামিলী নিয়ে থাকে। তাদের শুধু একটা মেয়ে। নাম নাফিসা। সে সিক্সে পড়ে। হাবিব ডাক্তার তাদের কাছে খায়। অবশ্য সেজন্য মাসিক টাকা দেয়।
সকাল আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত হেলথ কমপ্লেক্সে প্রচুর রুগীর ভিড় হয়। তাদেরকে পরীক্ষা করে ওষুধপত্র দিতে দু’জন ডাক্তার হিমশিম খেয়ে যায়। বিকেলে রুগী দেখা হয় না। আর্জেন্ট কোনো রুগী এলে সাগীর দেখে। হাবিব বিকেল চারটের সময় সাইকেলে ডাক্তারী ব্যাগ ঝুলিয়ে কলে বের হয়। কল থাকুক বা না থাকুক প্রতিদিন বেরিয়ে আশপাশের গ্রামের গরিব ও দুস্থ যারা হেলথ কমপ্লেক্সে যেতে অক্ষম, তাদের চিকিৎসা করে। আজ বিকেলে কলে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় নাদের আলি হন্তদন্ত হয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, জলদি চলুন ডাক্তার সাহেব, পশ্চিমপাড়ায় আগুন লেগে অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। হাশেম চাচার মেয়ে মারাত্মক আহত হয়েছে। হেড স্যার আপনাকে এক্ষুণি যেতে বলেছেন।
হাবিব ডাক্তার আতঙ্কিত স্বরে বলল, হাশেম চাচার মেয়ের কি হয়েছে তুমি দেখেছ?
জি না। আমি আগুন নেভাতে গিয়েছিলাম। পৌঁছানর সঙ্গে সঙ্গে হেড স্যার ঐ কথা বলে আপনার কাছে পাঠালেন।
আগুন নেভান হয়েছে?
আমি যাওয়ার আগেই নেভান হয়েছে।
হাবিব ডাক্তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে নিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে বলল, তুমি এস, আমি যাচ্ছি।
.
কুতুবপুর মাধ্যমিক স্কুলের হেড মাস্টার আজরাফ হোসেনের বাড়ি পশ্চিমপাড়ায়। আর্থিক অবস্থা ভালো। তিনি গ্রামের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। প্রায় একযুগ আগে বিয়ে করেছেন; কিন্তু আজও সন্তানের মুখ দেখেন নি। বিয়ের চার-পাঁচ বছরের মধ্যে স্ত্রীর গর্ভে সন্তান না আসায় তারই জিদে ঢাকায় গিয়ে একজন বড় ডাক্তারের কাছে দুজনেরই পরীক্ষা করান। পরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন, “আপনাদের কারো কোনো দোষ নেই। আপনার যেমন সন্তান জন্মাবার উপাদান আছে, আপনার স্ত্রীরও তেমনি সন্তান গর্ভে ধারণ করার ক্ষমতাও আছে। অনেক সময় অনেকের দেরিতে সন্তান আসে। এজন্য দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।” তারপর আজ যে সাত বছর হতে চলল, এখনও তাদের সন্তান হয় নি। অবশ্য এজন্য আজরাফ হোসেনের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু তার স্ত্রী তাসনিমা খাতুন সন্তানের জন্য অস্থির হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। গভীর রাতে গুমরে গুমরে কাঁদেন।