মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যিনি দশ লাখ টাকা দিয়েছেন, সেই দানবীর মহান ব্যক্তিকে দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ এসেছে। তারা হাসিবুর রহমানের কথা শুনে অল্পক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে গেলেও একসঙ্গে বলে উঠল, নিশ্চয় আপনি দাবি করতে পারেন, এটা আপনার ন্যায্য দাবি। তারপর হট্টগোল শুরু হয়ে গেল।
হাসিবুর রহমান হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলে বললেন, আপনারা হৈচৈ করবেন না। আমার আরো কিছু বলার আছে।
তার কথা শুনে মুহূর্তে সবাই নীরব হয়ে গেলে কেউ কিছু বলার আগে হাফেজিয়া মাদ্রাসার সেক্রেটারি আব্দুল জব্বার বললেন, আপনার কথামতো আপনি সম্পত্তির হকদার; কিন্তু আপনিই যে হারুন বিশ্বাসের প্রথম স্ত্রীর সন্তান, তার প্রমাণ দিতে হবে।
হাসিবুর রহমান বললেন, একটু আগে বলেছি, আমার মায়ের মৃত্যুর কারণ এই গ্রামের যারা বয়স্ক লোক তারা জানেন। আরো জানেন, আমার খালা আমাকে মানুষ করার জন্য নিয়ে চলে যান। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। আমি খালা খালুকেই নিজের মা বাবা বলে জানতাম। লেখাপড়া করিয়ে ব্যবসায় নামিয়ে যখন আমার বিয়ে দেবেন ঠিক করলেন তখন একদিন খালার সামনে খালু আমার আসল পরিচয় এবং কেন তারা আমাকে নিয়ে এসে মানুষ করেছেন, সব কিছু বললেন। তারপর একটা ডায়েরী আমার হাতে দিয়ে বললেন, এতে তোমার মা বাবার বংশের পরিচয় ও যা কিছু বললাম সব লেখা আছে। এর ভেতর তোমার শিশুকালের ফটোও আছে। সেই ডায়েরীটা ও আমার মায়ের খুনের মামলার কাগজপত্র কোর্ট থেকে তুলে এনেছি এবং দামুড়হুদা থানায় প্রথমে যে খুনের কেস দেয়া হয়েছিল, সেই কাগজপত্রের নকলও তুলে এনেছি। সেসব চেয়ারম্যান সাহেবকে দেখিয়েছি। আপনারাও দেখতে পারেন।
আব্দুল জব্বার আজরাফ হোসেন ও অন্যান্য কয়েকজন গণ্যমান্য বয়স্ক লোক সেসব কাগজপত্র ও ডায়েরী দেখে বললেন, হ্যাঁ, আপনি যা কিছু বলেছেন সব সত্য।
তারা থেমে যেতে চেয়ারম্যান সবকিছু মুশতাক বিশ্বাসের হাতে দিয়ে বললেন, আপনিও দেখুন।
হাসিবুর রহমানের কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাস এত অবাক হয়েছেন যে, চেয়ারম্যানের কথা কানে গেল না। কাগজপত্র হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
পারভেজ আব্বার পাশে ছিল। সে তার হাত থেকে সেগুলো নিয়ে পড়তে লাগল।
মুশতাক বিশ্বাসের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হাসিবুর রহমান বললেন, “মুসলমান হয়ে আর এক মুসলমানকে সবার সামনে অপদস্থ করা কোনো মুসলমানেরই উচিত নয়।” এটা হাদিসের কথা। মুশতাক বিশ্বাস আমার সতেলা ভাই এর ছেলে। তাকে গ্রামবাসীর কাছে আমিও অপদস্থ করতে চাই নি। একাকী এসব কথা বললে উনি বিশ্বাস করতেন না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একরকম বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছে। তা ছাড়া আরো একটা কথা, যা সকলের জানা দরকার। বংশ মর্যাদা থাকা ভালো। তাই বলে অন্য বংশকে ছোট মনে করা উচিত নয়। কথায় আছে, “ব্যবহারে বংশের পরিচয়।” উচ্চ বংশের লোকদের যদি ব্যবহার খারাপ হয় অথবা চরিত্রহীন ও ধর্মের প্রতি উদাসীন হয়, আর অখ্যাত বংশের লোকেরা যদি ধার্মিক ও চরিত্রবান হয়, তা হলে ইসলামের দৃষ্টিতে ও সব মানুষের কাছে ঐ অখ্যাত বংশটাই উচ্চবংশ। আমাদের রাসুল (দঃ) বলেছেন, “এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। তাদের একজনের শরীরে আঘাত লাগলে সারা বিশ্বের মুসলমান সেই আঘাত অনুভব করবে।” তাই কোনো কারণে যদি কারো সঙ্গে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়, তা হলে তা জিইয়ে না রেখে তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলতে হবে। হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, “মুসলমান ঐ ব্যক্তি যাহার রসনা ও হস্ত হইতে অন্যান্য মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে এবং বিশ্বাসী ঐ ব্যক্তি যাহার হাতে সকল লোকের ধন-প্রাণ নিরাপদ থাকে।”[ বর্ণনায় হযরত আব্বুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ)-বুখারী, মুসলিম।]
তাই বলব, শুধুমাত্র অন্য বংশের মেয়ে হওয়ার কারণে রহিম বিশ্বাস পুত্র বধূকে হত্যা করে যে পাপ করেছেন, ছেলে হারুন বিশ্বাস ও পোতা মুশতাক বিশ্বাসের তার প্রতিকার করে সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু তারা তা করেন নি। আর সেই কাজটা করেছে হারুন বিশ্বাসের সতেলা ভাইয়ের চার পোতার ছোট পোতা হাবিবুর রহমান ওরফে আপনাদের হাবিব ডাক্তার। কি করেছে জানেন, এই গ্রামের খাঁ বংশের নাদের আলির সঙ্গে মুশতাক বিশ্বাসের মেয়ে আতিকার বিয়ে দিয়ে দুই বংশের শত্রুতা মিটিয়ে ফেলার রাস্তা করে দিয়েছে এবং এই এলাকার মানুষের মন জয় করে এখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থাও করেছে। তাকে এসব করার জন্য আমিই পাঠিয়েছিলাম। তার দ্বারা। আল্লাহ আমার মনের আশা পূরণ করেছেন। তাই তার পাক দরবারে জানাচ্ছি শত কোটি শুকরিয়া। আর সম্পত্তির দাবি করে মুশতাক বিশ্বাসের কাছে যে উকিল নোটিশ আমি পাঠিয়েছিলাম, তা মরহুম দাদাজী রহিম বিশ্বাসকে আল্লাহ যেন মাফ করে দেন সেই ব্যবস্থা করার জন্য। আল্লাহ আমাকে ধন ও মান অনেক দিয়েছেন। এখানকার সম্পত্তির উপর আমার এতটুকু লোভ নেই। মুশতাক বিশ্বাস মাদ্রাসায় পাঁচ বিঘে জমি ও পঁচিশ হাজার টাকা দান করেছেন জেনে খুব আনন্দিত হয়েছি। এর জাজা আল্লাহ তাকে দেবেন। এখন উনি যদি সতেলা দাদির নামে এই মাদ্রাসায় আরো দশ বিঘে জমি ও একলক্ষ টাকা দান করার ওয়াদা করেন এবং নাদের আলিকে সম্মানের সঙ্গে জামাই বলে গ্রহণ করেন, তা হলে আমি সম্পত্তির জন্য যে মামলা দায়ের করেছি, তা তুলে নেব। তারপর তিনি চুপ করে গেলেন।