হাবিব ডাক্তার বলল, তাদের সঙ্গে আলাপ করা লাগবে না। কাল শুক্রবারের পরের শুক্রবার ভীত দেয়া হবে, একথা সবাইকে জানিয়ে দিন। তারা আগের দিন এসে যাবেন। এরমধ্যে মাদ্রাসার নামের সাইনবোর্ডটা তৈরি করিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবেন।
তাতো করবই। আচ্ছা, মাতব্বর সাহেবের কি যেন সমস্যা সমাধান করে দেবেন বলেছিলেন, তা করছেন?
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, মাদ্রাসার ভীত দেয়ার সময় দাদাজী সমাধান করে দেবেন। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। আপনি কিন্তু ঐদিন সকাল সাতটার মধ্যে চলে আসবেন। একসঙ্গে নাস্তা খেয়ে সবাই রওয়ানা দেব।
ঠিক আছে আসব। এখন তাহলে আসি?
দয়া করে আর একটু বসুন, এতক্ষণ শুধু আলাপই হল। এবার চা-নাস্তা খান, তারপর যাবেন।
.
পরের দিনই চেয়ারম্যান কয়েকজনকে দিয়ে নিজেদের ও আশপাশের সব গ্রামে ঢেড়া পিটিয়ে দিলেন, “যে মহৎ লোকের উদ্যোগে ও যার মোটা অঙ্কের দানে কুতুবপুর গ্রামে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তিনি……..তারিখে শুক্রবার সকাল দশটায় ভীত দেয়ার জন্য আসবেন। আপনাদের সবাইকে ঐ সময়ের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।”
কথাটা শোনার পর মুশতাক বিশ্বাস একদিন হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে বললেন……তারিখে মাদ্রাসার ভীত দেয়া হবে। তুমি তো বলেছিলে তার আগেই উকিল নোটিশের নিষ্পত্তি করে দেবে? সে ব্যাপারে তো কিছু করলে না?
হাবিব ডাক্তার বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। মাদ্রাসার ভীত দেয়ার দিনই ইনশাআল্লাহ নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
মুশতাক বিশ্বাস অবাক কণ্ঠে বললেন, মাদ্রাসার ভীত দেয়ার সঙ্গে উকিলী নোটিশের কি সম্পর্ক, বুঝতে পারছি না।
মাফ করবেন, এখন আপনাকে বোঝাতে পারব না। তবে যা বললাম, তা হবেই।
মুশতাক বিশ্বাস রেগে উঠে বললেন, তুমি কী আমাকে ছেলেমানুষ পেয়েছ? যা বলবে তাই বুঝে নেব?
ছি ছি, এ কী বলছেন? আপনাকে আমি বাবার মতো মনে করি। তাই ছেলে হিসাবে যা করা উচিত, ঐদিন তাই করব। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। তারপর আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিল।
১০. আজ নতুন মাদ্রাসার ভীত দেয়ার দিন
আজ নতুন মাদ্রাসার ভীত দেয়ার দিন। তেঁড়া দেয়ার ফলে প্রচুর লোকের সমাগম হয়েছে। বড় রাস্তা থেকে মাদ্রাসা পর্যন্ত যে রাস্তা ছিল, সেটা দিয়ে গাড়ি আসবে না। হাবিব ডাক্তারের কথায় চেয়ারম্যান আগেই মাটি ফেলে রাস্তা চওড়া করিয়েছেন। বেলা দশটার সময় একটা বড় মাইক্রোবাস সেই রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় থামল।
গণ্যমান্য লোকেরা অভ্যর্থনা জানানোর জন্য গাড়ির কাছে এগিয়ে এলেন।
গাড়ি থেকে প্রথমে হাবিব ডাক্তারকে নামতে দেখে সবাই অবাক হল। তারপর চেয়ারম্যান নামার পর একে একে হাবিব ডাক্তারের দাদাজী হাসিবুর রহমান, বাবা খলিলুর রহমান ও তিন ভাই নামার পর নাদের আলিকে নামতে দেখে সবাই আর একবার অবাক হল। গাড়িতে তিনজন বোরখাপরা মেয়ে বসে রইল। তাদের মধ্যে একজন আতিকা আর অন্য দু’জন হাবিব ডাক্তারের দাদি ও মা। আতিকা বোরখা পরে রয়েছে। তাই তাকে কেউ চিনতে না পারলেও মুশতাক বিশ্বাস, পারভেজ ও আজরাফ হোসেন অনুমান করতে পারলেন, ওদের মধ্যে একজন নিশ্চয়ই আতিকা।
হাসিবুর রহমানের বয়স সত্তর হলেও সুঠাম দেহের অধিকারী। পাজামা পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি ও পাকা চুল দাড়িতে তাকে দরবেশের মতো দেখাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দিলেন।
যারা সামনে ছিলেন, তারা সালামের উত্তর দিয়ে একে একে হাত মোসাফাহা করলেন। চেয়ারম্যান গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে হাসিবুর রহমান ও তাঁর ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর হাসিবুর রহমানকে দেখিয়ে সমস্ত লোকজনদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ইনিই এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ও দশ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। আজ ভীত দিতে এসেছেন। তারপর আজরাফ হোসেনকে বললেন, চলুন প্রথমে ভীত দেয়ার কাজটা সেরে ফেলি।
হাসিবুর রহমান তিনটে ইট গাঁথার পর মিস্ত্রীদের কাজ শুরু করতে বলে চেয়ারম্যানকে বললেন, সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়েছেন?
জি, ঐ যে সামনে দেখা যাচ্ছে। আপাতত দু’টো খুঁটি পুঁতে টাঙ্গান হয়েছে। বিল্ডিং হওয়ার পর প্রবেশ পথের গেটের উপর লিখে দেয়া হবে।
হাসিবুর রহমান প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসুল (দঃ) এর উপর কয়েকবার দরুদ পাঠ করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই মাদ্রাসায় প্রথমে দাখিল (দশম) শ্রেণী পর্যন্ত এবং পর্যায়ক্রমে আলিম, ফাজিল ও কামিল চালু করা হবে। কমিটির সদস্যদের কাছে অনুরোধ করব, তারা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিল্ডিং-এর কাজ শেষ করে ক্লাস শুরু করার ব্যবস্থা করেন। শিক্ষক নিয়োগের আগে আমরা আসব। আমরা আখলাকওয়ালা হাক্কানী আলেমদের শিক্ষক নিয়োগ করতে চাই। যারা ছাত্রদেরকেও আখলাকওয়ালা হাক্কানী আলেম গড়ে তুলবেন। এই মাদ্রাসা চালু হওয়ার পর মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হবে। তারপর হাবিব ডাক্তার চেয়ারম্যানকে এতিমখানা, ছাত্র ও শিক্ষকদের জন্য আবাসিক হোস্টেল ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে যে সব কথা বলেছিল, সেসব বলে বললেন, এইসব করার জন্য ইনশাআল্লাহ টাকা পয়সা আমি তো দেবই, আশা করব, তওফিক অনুযায়ী আপনারাও সাহায্য সহযোগিতা করবেন। আপনারা হয়তো ভাবছেন, আমি ঢাকার লোক হয়ে এই অজপাড়াগাঁয়ে এসব করছি কেন? তা হলে শুনুন, আমার মা মরহুমা জোহরা খানুম এই গ্রামেরই খাপাড়ার মেয়ে। আমার নানার নাম মরহুম সহিদুর রহমান খান। আমার আব্বার নাম মরহুম হারুন বিশ্বাস। আর দাদার নাম মরহুম রহিম বিশ্বাস। তারপর মায়ের মৃত্যু ও মৃত্যুর কারণ বলে বললেন, এখানে খাঁপাড়ার যারা মুরুব্বী লোক আছেন, তারা নিশ্চয় ঘটনাটা জানেন। ঘটনা যাই হোক না কেন, ধর্মীয় ও দেশের আইন অনুযায়ী আমি মরহুম হারুন বিশ্বাসের ছেলে এবং মুশতাক বিশ্বাসের বাবার সতেলা ভাই। পুত্র হিসাবে আমি মরহুম হারুন বিশ্বাসের সম্পত্তির অর্ধেক মালিক এবং আমার মা মরহুমা জোহরা খানুম স্ত্রী হিসাবে একের আট অংশের মালিক। এখন আপনারাই বলুন আমি এই সম্পত্তি দাবি করতে পারি কিনা? তারপর তিনি চুপ করে গেলেন।