যীনাতকে বিয়ে করার কথা শুনে সবাই যতটা না অবাক হয়েছিল, আতিকা ও নাদের আলির ব্যাপারে সবকিছু শুনে আরো বেশি অবাক হয়ে অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। অনেকে বলাবলি করতে লাগল, হাবিব ডাক্তারের মতো ভালো মানুষের নামে মাতব্বর সাহেবের সালিশ ডাকা ঠিক হয় নি। ওনার মতো লোক এই জামানায় আছে কিনা সন্দেহ। ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে যার তার কথায় সালিশ ডাকা কি উচিত হয়েছে?
আজরাফ হোসেন সবাইকে চুপ করতে বলে বললেন, যীনাত আমার চাচাত বোন। হাবিব ডাক্তার আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করার সময় তাকে দেখে ও তার সবকিছু জেনেও আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমিই গদের বিয়ের ব্যবস্থা করি। তিনি বিয়ের কথা গোপন রাখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তাই প্রকাশ করি নি। ওদের কুসম্পর্কের কথা জানার পর মাতব্বর সাহেবের উচিত ছিল, আমার সঙ্গে বা হাশেম চাচার সঙ্গে আলাপ করা। কেন যে উনি তা না করে সালিশ ডাকলেন বুঝতে পারছি না। আমি এই কয়েকদিন বাড়িতে ছিলাম না। গত সন্ধ্যায় ফিরেছি। আজ সকালে মাতব্বর সাহেবের লোক আসার জন্য খবর দিতে এসেছি। যাই হোক, মানুষ মাত্রই ভুল করে। আমার মনে হয়, উনি ভুলই। করেছেন। তারপর চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি বলেন?
চেয়ারম্যান বললেন, হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। উনি আপনার সঙ্গে বা হাশেম আলির সঙ্গে আলাপ না করে ভুলই করেছেন। তারপর মুশতাক বিশ্বাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আতিকা ও নাদের আলির ব্যাপারে হাবিব ডাক্তারকে কি শাস্তি দিতে চান আপনিই বলুন।
যীনাতের ব্যাপারে যে ভুল করেছেন, তা বুঝতে পেরে মুশতাক বিশ্বাস নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে গেলেন। তাই চেয়ারম্যানের কথা শুনে কি বলবেন চিন্তা করতে লাগলেন।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে হাবিব ডাক্তার বলল, মাতব্বর সাহেব যা শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেব একটু আগে বলেছি। তার আগে আপনাদের সবাই-এর কাছে অনুরোধ, নতুন মাদ্রাসার ভীত দেয়া না হওয়া পর্যন্ত উনি যেন শাস্তির কথা ঘোষণা না করেন। তার কারণ উনি একটা সমস্যা সমাধানের জন্য আমার কাছে সাহায্য চেয়েছেন। আমি সাহায্য করার ওয়াদা করেছি। আশা করি, ইনশাআল্লাহ নতুন মাদ্রাসার ভীত দেয়ার আগেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারব।
কেউ কিছু বলার আগে আজরাফ হোসেন বলে উঠলেন, আমি হাবিব ডাক্তারের অনুরোধ অনুমোদন করলাম।
তিনি থেমে যেতে চেয়ারম্যান বললেন, আমিও অনুমোদন করছি।
তারপর অন্যান্য গণ্যমান্য লোকেরাও তাই বললেন।
মুশতাক বিশ্বাস কিছু না বলে চুপ করেই রইলেন।
পারভেজ আগে হাবিব ডাক্তারকে সবাই-এর মতো ভালো মনে করত। এখন তার কথা শুনে খুব মহৎ মনে হল। আব্বার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, আব্বার পক্ষ থেকে আমিও অনুমোদন করছি।
নাদের আলির ফুফু হানিফা খাতুনকে এতক্ষণ হাবিব ডাক্তার লক্ষ্য করে নি। এখন দেখতে পেয়ে তার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে বলল, ঐ বৃদ্ধাকে সালিশীতে ডেকে আনা উচিত হয় নি। দোষ করলে নাদের আলি করেছে, উনি তো করেন নি? একজনের দোষে অন্যজনকে শাস্তি দেয়ার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয় নি।
চেয়ারম্যান হানিফা খাতুনকে বললেন, আপনাকে ডেকে আনার জন্য সবাই এর পক্ষ থেকে আমি মাফ চাইছি। আপনি ঘরে চলে যান।
হানিফা খাতুন চাদরমুড়ি দিয়ে ও ঘোমটা দিয়ে একপাশে গুটিশুটি হয়ে বসেছিলেন। চেয়ারম্যানের কথা শুনে উঠে চলে গেলেন।
চেয়ারম্যান সালিশীর কাজ শেষ ঘোষণা করে সবাইকে চলে যেতে বললেন। সবাই চলে যাওয়ার পর মুশতাক বিশ্বাসকে বললেন, আসলে হাবিব ডাক্তার খুব সৎ ছেলে। তার নামে সালিশ ডাকার আগে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। তারপর পারভেজকে বললেন, তোমার আব্বা না হয় ভুল করেছেন, শিক্ষিত ছেলে হয়ে তোমারও ভুল করা উচিত হয় নি। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। একটা কথা না বলে পারছি না, পূর্ব-পুরুষদের শত্রুতার জের জিইয়ে না রেখে মিটিয়ে ফেলাই ভালো। আপনারা যে কাজ পারেন নি, হাবিব ডাক্তার সেই কাজ করার চেষ্টা করেছেন। মনে রাখবেন, আপনাদের একটিমাত্র মেয়েকে বাঁচানোর জন্য তিনি যা করেছেন, তা দোষের নয়, বরং প্রশংসনীয়। তা ছাড়া ভেবে দেখুন, আপনি তার নামে সালিশ ডাকার পরও আপনার সমস্যার সমাধান করে দেবেন বললেন। এটা কি তার মহৎ গুণের পরিচয় নয়? কথাগুলো চিন্তা করে দেখবেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার পর পারভেজ আব্বাকে বলল, আপনাকে কবে থেকে বলছি, মাতব্বরী ছেড়ে দেন, আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করে বাকি জীবন কাটান। আমার কথা শুনলে গ্রামের সবার কাছে আজ অপদস্থ হতেন না।
মুশতাক বিশ্বাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, তোমার কথা না শুনে ভুলই করেছি। আর সেই ভুলটা তুমি ছেলে হয়ে শুধরে দিতে না পারলেও আজ হাবিব ডাক্তার পেরেছে।
.
এই ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর একদিন চেয়ারম্যান কার্পাসডাঙ্গা গিয়ে হাবিব ডাক্তারকে মাদ্রাসার জন্য জমি রেজিস্ট্রি ও টাকা পয়সা আদায়ের কথা জানিয়ে বললেন, আপনি তো বলেছিলেন আপনার দাদাজী ভীত দেবেন। আপনার বাবা ও ভাইয়েরাও সঙ্গে থাকবেন। এবার তাদের সঙ্গে আলাপ করে দিন ঠিক করুন।