.
আজ তিন দিন হাবিব ডাক্তার তাদেরকে ঢাকায় নিজেদের বাসায় পাঠিয়েছে। তার বাবা খলিলুর রহমান প্রায় প্রতিদিন ফোন করে খবরা-খবর নেন। গত রাতে জানিয়েছেন, ঐদিনই বাসায় কাজি নিয়ে এসে তাদের বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারা ভালো আছে।
আজ বেলা দেড়টা পর্যন্ত রুগী দেখা শেষ করে রুমে যাবে, এমন সময় রসু এসে হাজির। বলল, কী খবর রসু?
রসু সালাম বিনিময় করে বলল, মাতব্বর সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আপনাকে যেতে হবে।
হাবিব ডাক্তার বলল, ঠিক আছে, আপনি যান। আমি যোহরের নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করে আসছি।
বিকেল চারটের সময় হাবিব ডাক্তার মুশতাক বিশ্বাসের বাড়িতে এসে দেখল, বৈঠকখানায় লোক গিজ গিজ করছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অন্যান্য পাড়ার মুরুব্বীরা, চেয়ারম্যান ও আজরাফ স্যারও রয়েছেন। মাতব্বর সাহেব তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। সাইকেল স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে সালাম দিয়ে মুশতাক বিশ্বাসকে উদ্দেশ্য করে বলল, রসুর কাছে শুনলাম আপনি খুব অসুস্থ! কিন্তু আপনাকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না?
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, আমার কিছু হয় নি। ঐ কথা বলে তোমাকে আনার জন্য রসুকে পাঠিয়েছিলাম। ওখানে বস বলে একটা খালি চেয়ার দেখালেন।
হাবিব ডাক্তার বসে বলল, মনে হচ্ছে, গ্রামের কোনো ব্যাপারে সালিশ ডেকেছেন। এর মধ্যে আমাকে ডেকে পাঠালেন কেন বুঝতে পারছি না?
মুশতাক বিশ্বাস চেয়ারম্যানকে বললেন, যা বলার এবার আপনি বলুন।
চেয়ারম্যান আসার পর মুশতাক বিশ্বাস তাকে নাদের আলি ও আতিকা হাবিব ডাক্তারের যোগসাজসে ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার কথা ও পশ্চিমপাড়ার হাশেম আলির মেয়ে যীনাতের সঙ্গে তার কুসম্পর্কের কথা জানিয়ে যখন বিচারের কথা বলেন তখন তিনি মনে মনে হাবিব ডাক্তারের প্ল্যানের প্রশংসা না করে পারলেন না। বললেন, ঘটনা সত্য প্রমাণ হলে হাবিব ডাক্তারের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আজরাফ মাস্টারকে খবর দেন নি?
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, কয়েকদিন আগে সে শ্বশুরবাড়ি সপরিবারে গিয়েছিল। গতকাল সন্ধ্যেয় ফিরেছে। তাকেও খবর দেয়া হয়েছে। এমন সময় আজরাফ হোসেনকে আসতে দেখে বললেন, ঐতো এসে গেছে।
আজরাফ হোসেন সালাম ও কুশল বিনিময় করে চেয়ারম্যানের পাশে বসলেন। তারপর মুশতাক বিশ্বাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হঠাৎ ডেকে পাঠালেন কেন?
চেয়ারম্যানকে যে সব কথা মুশতাক বিশ্বাস বলেছিলেন, সে সব কথা তাকেও বললেন।
আজরাফ হোসেন শুনে ভাবলেন, হাবিব ডাক্তার কিভাবে ম্যানেজ করে দেখা যাক। তাই কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
মুশতাক বিশ্বাসের কথায় চেয়ারম্যান হাবিব ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সালিশী বসেছে আপনাকে নিয়ে। কোনো কারণে আপনি যদি না আসেন, তাই মাতব্বর সাহেব নিজের অসুখের কথা বলে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আপনার বিরুদ্ধে দু’টো নালিশ আছে। তার একটা হল, পশ্চিমপাড়ার হাশেম আলির বাড়িতে আপনাকে রাতে যাতায়াত করতে অনেকে দেখেছে। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে সেখানে রাতেও থাকেন। এখন যীনাতের পেটে বাচ্চা এসেছে জেনে তারা মাতব্বর সাহেবের কাছে আপনাকে দায়ী করে বিচার দাবি করেছে। হাশেম আলি ও তার মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠান হয়েছিল। তারা আসে নি। বলেছে, সালিশীতে যা রায় হবে, তা তারা মেনে নেবে। দ্বিতীয় নালিশ হল, মাতব্বরের মেয়ে আতিকাকে নিয়ে নাদের আলির ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার পিছনে যে আপনার যোগসাজস আছে, তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এখন আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।
হাবিব ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি বলবে ভেবে নিয়ে বলল, প্রথম নালিশের জওয়াবে বলব, যীনাতকে আমি প্রায় ছয় সাত মাস আগে বিয়ে করেছি। তারপর পরিস্থিতি দেখার জন্য চুপ করে রইল।
তার কথা শুনে চেয়ারম্যান ও আজরাফ হোসেন ছাড়া সবাই খুব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
প্রথমে মুশতাক বিশ্বাস বললেন, শুধু মুখে বিয়ে করেছি বললে তো হবে না, প্রমাণ দেখাতে হবে।
হাবিব ডাক্তার বলল, বিশেষ কারণে আমি বিয়েটা গোপনে করেছি। আর যারা বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাদেরকেও কথাটা গোপন রাখতে বলেছিলাম। তাই তারা, হাশেম চাচা ও তার একজন আত্মীয় ছাড়া আর কেউ জানেন না।
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, যারা তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাদের নাম বল।
যে কারণে আমি গোপনে বিয়ে করেছি, সেই একই কারণে তাদের নাম বলতে পারব না। আমি খুব অবাক হচ্ছি, আপনারা হাশেম আলি চাচার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করেন নি কেন? তিনি মেয়ের বাবা, তাকে জিজ্ঞেস করলে সত্য মিথ্যা জানতে পারতেন।
এবার দ্বিতীয় নালিশের জওয়াবে বলব, দু’টো তরতাজা ফুলের মতো জীবনকে বাঁচবার জন্য আমাকে এই কাজ করতে হয়েছে। এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যে ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে দু’জনকেই অনেক বুঝিয়ে এই পথ থেকে ফিরে আসতে বলি; কিন্তু নাদের আলি কিছুটা বুঝলেও আতিকা বুঝল না। তার এক কথা, নাদের আলিকে ছাড়া সে বাঁচবে না। যদি বাবা মা জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, তা হলে বিয়ের আগেই বিষ খাবে। তাই সে একটা বিষের শিশি সব সময় কাছে রাখত। এসব জানার পর কিছুদিন আগে আমি মাতব্বর সাহেব ও তার ছেলের সঙ্গে ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আলাপ করি। ওঁরা আমার কথায় কান না দিয়ে অন্য জায়গায় আতিকার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। আমি একথা জানতাম না। একদিন সূতাপাড়া থেকে রুগী দেখে ফেরার সময় আতিকার সঙ্গে দেখা। সে বিয়ের কথা জানিয়ে বলল, আপনি তো আমার জন্য কিছুই করতে পারলেন না। তারপর বিষের শিশি দেখিয়ে বলল, এটা নিশ্চয় আমাকে সাহায্য করবে। আমি যে তাকে নিজের বোনের মতো মনে করি, তাও মাতব্বর সাহেবকে ঐদিন বলেছিলাম। তাই বড় ভাই হিসাবে ছোট বোনকে বাঁচবার জন্য বাধ্য হয়ে তাদেরকে ঢাকায় পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার জন্য সহযোগিতা করেছি। শুধু তাই নয়, তাদেরকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে বিয়ে পড়াবার ব্যবস্থাও করেছি। তারা বিয়ের পর আমাদের বাসাতেই সুখে দিন কাটাচ্ছে। এতে যদি আমার অন্যায় হয়ে থাকে, তবে যে। শাস্তি আপনারা দেবেন তা মাথা পেতে নেব। তারপর আমার আর কিছু বলার নেই বলে হাবিব ডাক্তার চুপ করে গেল।