রাগের মাথায় মেয়েকে মেরে শাফিয়া বানু অনুতপ্ত হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, ছিঃ মা, অমন কথা মুখে আনতে নেই। একটু বোঝার চেষ্টা কর, নাদের আলির পূর্ব পুরুষদের সময় থেকে আমাদের শত্রুতা। তোর আব্বা ও ভাইয়া কিছুতেই তাকে জামাই করতে রাজি হবে না। তারা তোকে ঢাকায় বড় লোকের শিক্ষিত ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার জন্য লোক লাগিয়েছে। নাদের আলি গরিব অল্প শিক্ষিত ছেলে। তার কি আছে? একটা ভালো ঘর-বাড়ি পর্যন্ত নেই। তা ছাড়া তুই তো জানিস, বিশ্বাস বাড়ির ছেলেমেয়ের বিয়ে অন্য কোনো গোষ্ঠীতে হয় না। শিক্ষিত মেয়ে হয়ে বংশ মর্যাদার কথা চিন্তা করবি না? এরকম পাগলামী করিস নি মা। ওকে মন থেকে মুছে ফেল।
আতিকা কান্না থামিয়ে বলল, এসব কথা আমি যেমন চিন্তা করেছি, নাদের আলি ভাইও তেমনি করেছে। তবু আমরা কেউ কাউকে ভুলতে পারছি না। মা হয়ে তুমি যদি কিছু একটা না কর, তা হলে গলায় ফাঁস দেয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই।
শাফিয়া বানু ভয়ার্তকণ্ঠে বললেন, বারবার ঐ কথা বলিস নি মা। জানিস না, যারা নিজের জান নিজে দেয়, তারা পরকালে জাহান্নামী হয়? এরকম কথা যারা চিন্তা করে, শয়তান তাদেরকে সুযোগ পেলেই তা করার জন্য ওয়াসওয়াসা দেয়। কারণ সে মানুষকে জাহান্নামী করতে চায়। আর কখনও ওরকম কথা চিন্তা করবি না। যা বলছি শোন, “নাদের আলিকে তোর সঙ্গে দেখা করতে আসতে নিষেধ করে দিয়ে বলবি, আব্বা জানতে পারলে তোমার খুব বিপদ হবে। আম্মা আমাদের ব্যাপারটা জেনে গেছে। সে আব্বাকে রাজি করাবার চেষ্টা করবে।”
মায়ের কথা বিশ্বাস করে আতিকা নাদের আলিকে কথাটা জানালেও তাদের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করে নি। মাঝপাড়ার কুলসুম, তার বান্ধবী। সে তাদের দু’জনের সম্পর্কের কথা জানত। কুলসুমদের বাড়িতে যাওয়ার নাম করে আতিকা নাদের আলির সঙ্গে দেখা করত। কুলসুমই তাদের দেখা করার সুযোগ করে দিত। বছর খানেকের মধ্যে বইরাপাড়ায় কুলসুমের বিয়ে হয়ে যেতে তাদের দেখা সাক্ষাতের সুযোগ আরো ভালো হল। বিশ্বাসপাড়া থেকে বইরাপাড়া যেতে হলে খাঁপাড়ার উপর দিয়ে যেতে হয়।
তারপরের বছর বন্যা হয়ে আশপাশের কয়েকটা ইউনিয়নের ঘর-বাড়ি, গরু-ছাগল ও অন্যান্য সবকিছু ভেসে যায়। বহু মানুষ ও গবাদি পশু মারা যায়। যারা বেঁচে ছিল তারা বহুদূরে সাঁতরে সাঁতরে আমবাগান, হার্টিকালচার, নাটোদা হাইস্কুল ও সরকারী শিবিরে আশ্রয় নেয়। যাদের পাকা বাড়ি ছিল তারা অনেককে আশ্রয় দেয়। সেই সময় কুলসুমের বাচ্চা হয়েছিল। সেও বন্যায় ভেসে গিয়ে মারা যায়। আর নাদের আলির মা বাবাও মারা যায়। শুধু নাদের আলি কোনো রকমে বেঁচে গেছে।
বন্যার পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া মানুষ যখন গ্রামে ফিরে আবার বাড়ি-ঘর তৈরী করে ক্ষেতে ফসল ফলাতে শুরু করল তখন আতিকা লোকের দ্বারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারল, নাদের আলি বেঁচে থাকলেও তার মা বাবা মারা গেছে। সে একটা বেড়ার ঘর তুলে তার এক বিধবা ফুফুকে নিয়ে থাকে। একদিন তার সেঙ্গে দেখা করে বলল, এই দু’আড়াই মাস তোমার চিন্তায় খেতে পারি নি। রাতে একফোঁটা ঘুমাতে পারি নি। আল্লাহ তোমাকে আমার জোড়া করেছে বলে হয়তো তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
মা বাবাকে হারিয়ে নাদের আলি বোবার মতো হয়ে গিয়েছিল। কোনো কথা না বলে তার দিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আর দু’চোখ থেকে পানি ফেলতে লাগল।
তার অবস্থা দেখে আতিকার চোখ থেকেও পানি পড়তে লাগল। এক সময় চোখ মুছে বলল, কেঁদে আর কী করবে? যা ভাগ্যে ছিল হয়েছে। এখন মন শক্ত করে সবকিছু গুছিয়ে ওঠার চেষ্টা কর। আমি তোমার জন্য আজীবন অপেক্ষা করব।
নাদের আলি চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, তুমি আর আমার কাছে এস। আমাকে ভুলে যাও আতিকা, আমাকে ভুলে যাও। যা কখনও সম্ভব নয়, তার জন্য অপেক্ষা করা ঠিক নয়।
এ কথা তুমি বলতে পারলে নাদের আলি ভাই? তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বুড়ি হয়ে যাব, প্রয়োজনে জান দেব, তবু অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আর তোমাকে ভুলতেও পারব না। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে চলে এল। তারপর মাঝে মাঝে চাকর হালিমকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দেখা করত। হাবিব ডাক্তারের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা বেড়ে যাওয়ার পর তার মনে হল, তাকে সব কথা জানিয়ে সমাধান চাইবে। উনি হয়তো কিছু করতে পারবেন। কারণ আব্বাও তাকে খুব মান্য করেন। এইসব চিন্তা করে আতিকা একদিন বিকেল চারটের সময় কার্পাসডাঙ্গা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গেল।
তাকে দেখে হাবিব ডাক্তার অবাক হয়ে সালাম বিনিময় করে বলল, আপনি এসেছেন কেন? কাউকে দিয়ে খবর পাঠালেই তো আমি যেতাম। কার কি হয়েছে বলুন।
আতিকা বলল, কারো কিছু হয় নি। নিজের প্রয়োজনে এসেছি।
ঠিক আছে বসুন। বসার পর জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছেন বলুন।
কিভাবে কথাটা বলবে আতিকা চিন্তা করতে লাগল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে হাবিব ডাক্তার মনে করল, মেয়েলী অসুখের কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। তাই বলল, সব ধরনের অসুখের কথা ডাক্তারের কাছে বলা যায়। এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। না বললে চিকিৎসা করব কি করে?