সে সব তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। পারভেজ ও বৌমা সব দায়িত্ব নিয়েছে। এখন খাবে চল। বৌমা ভাত বেড়ে বসে আছে।
আতিকার বিয়ের দিন ধার্য হল সামনের শুক্রবারের পরের শুক্রবার। মাঝখানে মাত্র দশদিন। গহনাপত্র আগেই বানিয়ে রেখেছিলেন মুশতাক বিশ্বাস। বাকি অন্যান্য সবকিছু কেনার দায়িত্ব পারভেজের উপর ছেড়ে দিলেন।
বিয়ের দু’দিন আগে সকাল থেকে আতিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না। শাফিয়া বানু পাড়ায় পাড়ায় ও জ্ঞাতি-গুষ্ঠীদের বাড়িতে যেখানে যেখানে আতিকা বেড়াতে যায়, সবখানে কাজের মেয়েকে দিয়ে খোঁজ করালেন; কিন্তু পাওয়া গেল না। এমনকি কেউ তাকে দেখে নি বলে জানাল। শাফিয়া বানু ভাবলেন, আতিকা নাদের আলির ঘরে চলে যাই নি তো? চাকর হালিমকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই খপাড়ার নাদের আলিকে চিনিস?
হালিম মাঝপাড়ার গরিবের ছেলে। তার বাবা যখন মারা যায় তখন তার বয়স ছয় বছর। বছর খানেক পর বইচিতলার একজনের সঙ্গে তার মায়ের আবার বিয়ে হয়। হালিম চাচাদের কাছে ছিল। আট বছর বয়সে চাচারা তাকে মুশতাক বিশ্বাসের বাড়িতে কাজে দেয়। এখন তার বয়স তের চৌদ্দ বছর। আতিকা তাকে খুব স্নেহ করে। ভালো মন্দ কিনে খাওয়ায়। মাঝে মধ্যে দু’পাঁচ টাকা দেয়। তাই আতিকা যা বলে তাই শোনে। তাকে দিয়েই আতিকা নাদের আলির সঙ্গে চিঠি লেন-দেন করে, দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে। হালিম আতিকাকে বুবু ডাকে। তার মা বাবাকে চাচা-চাচী ও পারভেজ ও তার স্ত্রীকে ভাই-ভাবি বলে ডাকে। সে কিশোর হলেও বুঝতে পেরেছে আতিকা বুবুও নাদের আলি ভাই একে অপরকে ভালবাসে। বিয়ের দিন ঠিক হওয়ার পর থেকে আতিকার মন খারাপ। সে গতকাল তাকে দিয়ে নাদের আলির কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। আজ তাকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে ভেবেছে, আতিকা বুবু নাদের আলি ভাইদের ঘরে পালিয়ে গেছে। তাই শাফিয়া বানু যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন নাদের আলিকে চেনে কিনা তখন ভয় পেলেও সাহস করে বলল, জে, চিনি।
তাদের ঘর চিনিস?
জে, চিনি।
তুই এক্ষুনি একবার তাদের ঘরে গিয়ে দেখে আসবি তোর আতিকা বুবু সেখানে আছে কিনা। খবরদার, চুপি চুপি যাবি আর আসবি। আমি যে তোকে পাঠিয়েছি, কাউকে বলবি না। ওখান থেকে সোজা আমার কাছে আসবি।
জে আচ্ছা, বলে হালিম বেরিয়ে গেল।
শাফিয়া বানু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। প্রায় একঘণ্টা পর হালিম ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, আছে?
হালিম মন ভার করে বলল, না নেই।
নাদের আলি আছে?
সেও নেই।
ঘরে আর কে কে আছে?
নাদের আলি ভাইয়ের তো কেউ নেই, শুধু এক ফুফু আছে। তাকে জিজ্ঞেস করতে বলল, কাজে গেছে।
ঠিক আছে, তুই তোর কাজে যা বলে শাফিয়া বানু চিন্তা করলেন, আর দেরি করে স্বামী ও ছেলেকে কথাটা জানান দরকার।
পারভেজের স্ত্রী সায়লা ননদকে সকাল থেকে দেখতে না পেয়ে শাশুড়ীকে কয়েকবার তার কথা জিজ্ঞেস করেছে। পাড়ার কারো বাড়িতে হয়তো বেড়াতে গেছে বলে তিনি এড়িয়ে গেছেন। দুপুর হয়ে যেতেও যখন তাকে ফিরতে দেখল না তখন সায়লা শাশুড়ীকে বলল, আম্মা, বুবুতো এখনও এল না, কোথায় গেল একটু খোঁজ নিলে হত না?
শাফিয়া বানু চিন্তিত মুখে বললেন, মেয়েটা দিন দিন খুব বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। কোথাও গেলে বলে যাবি তো? তা না, সেই যে সকালে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়েছে, এখনও ফেরার নাম নেই।
সায়লা বলল, আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে আম্মা!
এতে তোমার আবার ভয় পাওয়ার কি আছে?
আনন্দবাস থেকে যেদিন লোকজন এসে বিয়ের দিন ঠিক করে গেল, সেদিন তার মন খারাপ দেখে বললাম, বুবু তোমার মন খারাপ কেন? এখন তো খুশি হওয়ার কথা? বলল, এ বিয়েতে আমার মত নেই। আমি বললাম কেন? বলল, সে কথা তোমাকে বলা যাবে না। অনেক আদর ও কাকুতি মিনতি করতে বলল, আমি এই গ্রামের একটা ছেলেকে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ভালবাসি। তাকে ছাড়া আর কারো সঙ্গে বিয়ে বসতে পারব না। জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেটাও কি তোমাকে ভালবাসে? বলল, হ্যাঁ, সেও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। ছেলেটার পরিচয় জানতে চাইতে বলল, আম্মা, আব্বা ও ভাইয়া জানে। তারা ঐ ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানতে পেরে আনন্দবাসের একটা বাজে ছেলের সঙ্গে তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিতে যাচ্ছে। আমারও এক কথা, তাকে ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিলে যা করব, তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
তুমি কী কথাগুলো পারভেজকে বলেছ?
জি, ঐদিন রাতেই বলেছি।
শুনে পারভেজ কি বলল?
খুব রেগে উঠে বলল, এসব কথা কাউকে বলবে না। ও যাকে ভালবাসে, তার বংশের সঙ্গে আমাদের দুশমনি। আতিকা আমার একমাত্র বোন। তাকে আমি যে কতটা ভালবাসি তা তুমিও জান। তবু দুশমনি বংশের ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে কিছুতেই দিতে পারি না। তা ছাড়াও ছেলেটা অন্য বংশের। বিশ্বাস বংশের হলেও না হয় কথা ছিল। ওর জন্য আমরা বংশের সম্মান নষ্ট করতে পারি না। তাই আমরা অন্য গ্রামের বিশ্বাস বংশেই বিয়ের ব্যবস্থা করেছি।
আমি বললাম, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু বুবু তো বলছিল, ছেলেটা নাকি খুব খারাপ?
ছেলে ভালো না খারাপ, তা আমরা না জেনে কি বিয়ে দিচ্ছি? ওর কথা আর বলবে না, পারলে ওকে বোঝাও।
শাফিয়া বানু বললেন, তুমি ওকে বুঝিয়েছিলে?
সায়লা বলল, বোঝাতে চেয়েছিলাম; কিন্তু দু’একটা কথা বলতে না বলতে রেগে উঠে আমার কাছ থেকে চলে গেল। তারপর বলল, এখন কি হবে আম্মা?