ছেলে খুব রেগে আছে মুশতাক বিশ্বাস বুঝতে পেরে বললেন, মাথা গরম করবে না। যা করার চিন্তা ভাবনা করে করতে হবে।
তা না হয় করা যাবে? ওদের সম্পর্কের কথা জানতেন কিনা বলুন।
আগে জানতাম না, কিছুদিন আগে বইরাপাড়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার মিটিং সেরে ফেরার সময় মাঝপাড়ার রশিদ শেখের পুকুরপাড়ে আতিকাকে নাদের আলির সঙ্গে কথা বলতে দেখি। সঙ্গে গিয়াস ছিল, সেও তাদেরকে দেখেছে। ঐদিনই গিয়াসকে তার লোকজন নিয়ে গভীর রাতে নাদের আলির হাত-পা ভেঙ্গে দিতে বলি। গিয়াস লোকজন নিয়ে গিয়েছিল, তারপর যা ঘটেছে বললেন।
আব্বার কথা শুনে পারভেজের রাগ পড়ল। বলল, নাদের আলির বাস্তুতে জিন থাকে, কই, আমি তো কখনো শুনি নি?
তুমি তো সেদিনের ছেলে, আমিই কোনো দিন শুনি নি। এখন ওসব কথা বাদ দাও। আমি চিন্তা করছি, হাবিব ডাক্তারের কথা। সে কেন নাদের আলির সঙ্গে আতিকার বিয়ে দেয়ার এত আগ্রহী?
পারভেজ বলল, উনি মহৎ লোক, হয়তো বিয়ের মাধ্যমে দু’বংশের শত্রুতা মিটিয়ে দিতে চান।
মনে হচ্ছে তোমার কথা ঠিক। তবু আমার যেন কেমন মনে হচ্ছে, তার আরো কোনো উদ্দেশ্য আছে।
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। আর যদি থেকেও থাকে, তা হলে ভালো ছাড়া মন্দ হতে পারে না। কেননা ওঁর মতো ছেলে কারো ক্ষতি করতে পারেন না। তবে নাদের আলির সঙ্গে আতিকার বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না।
তাতো নিশ্চয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালো ছেলে দেখে আতিকার বিয়ে দিতে হবে। আমার আর একটা ব্যাপার সন্দেহ হচ্ছে, নাদের আলির উন্নতির পিছনে হাবিব ডাক্তারের হাত আছে।
আপনার এরকম মনে হল কেন?
তা না হলে হঠাৎ করে নাদের আলি এত টাকা-পয়সা পেল কোথায় যে, এই দেড় বছরের মধ্যে এতকিছু করে ফেলল। গ্রামে এমন কেউ কি আছে, যে নাকি তাকে শুধু শুধু টাকা-পয়সা দেবে? আল্লাহ ইচ্ছা করলে যাকে ইচ্ছা ধনী-গরিব করতে পারেন ঠিক, তবে তিনি তা কারো দ্বারা করিয়ে থাকেন। এবার আমার সন্দেহের কারণটা নিশ্চয় বুঝতে পারছ?
জি পেরেছি।
তা হলে এক কাজ কর, হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে তোমার তো খুব জানাশোনা, বুদ্ধি করে তার কাছ থেকে জানার চেষ্টা কর।
পারভেজ বলল, ঠিক আছে আব্বা, তাই জানার চেষ্টা করব।
০৭. চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান
হাবিব ডাক্তার একদিন চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানের পাঁচ বছরের পোতা হাবিবুর রহমানকে দেখতে কাঁটাবাগান পাড়ায় গেল। দু’দিন থেকে একশ চার জ্বর। মাথায় পানি ঢেলেও জ্বর কমে নি। জ্বরের ঘোরে চোখ খুলতে পারে না। কোনো কিছু খায়ও না। রুগীকে পরীক্ষা করে হাবিব ডাক্তার বলল, ভয়ের কিছু নেই। ইনশাআল্লাহ জ্বর কমে যাবে। তারপর একগ্লাস পানি আনতে বলল।
চেয়ারম্যান নিজেই এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন।
হাবিব ডাক্তার কিছু পড়ে রুগীর গায়ে ফুক দিল। তারপর আরো কিছু পড়ে গ্লাসের পানিতে ফুক দিয়ে রুগীকে দু’তিন চামচে খাইয়ে ডান হাতের তালুতে অল্প একটু পানি নিয়ে রুগীর গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলল, আজ আর কোনো ওষুধ দেব না। রাতের মধ্যে যদি জ্বর না কমে, তবে সকালে কাউকে আমার কাছে পাঠাবেন।
হাবিব ডাক্তার যে ঝাড়ফুঁক ও পানি পড়া দিয়ে অনেক রুগী ভালো করেছে, তা চেয়ারম্যান শুনেছেন। তাই অবাক না হয়ে বললেন, মেডিক্যাল সাইন্সেতো এসব বিশ্বাস করে না। তবু আপনি করেন কেন?
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, শুধু মেডিক্যাল সাইন্স নয়, সাইন্সের কোনো থিওরিই পারমানেন্টও নয়, সঠিকও নয়।
এমন সময় চেয়ারম্যানের বড় ছেলে হামিদুর রহমান এসে বলল, আব্বা, বারান্দায় চা দেয়া হয়েছে।
চেয়ারম্যান বললেন, চলুন ডাক্তার, আমরা বারান্দায় গিয়ে বসে একটু চা খাই।
চা খাওয়ার সময় চেয়ারম্যান বললেন, জ্বর কমার জন্য কিছু ওষুধ দিলে হত না?
হাবিব ডাক্তার সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনার এই পোতাকে একটু সাবধানে রাখবেন। দুপুরে ও সন্ধ্যার সময় একা একা ঘরের বাইরে যেন না যায়, সবাইকে একটু খেয়াল রাখতে বলবেন। মনে হচ্ছে ওকে বাতাস লেগেছে। তাই আল্লাহর কালাম থেকে কিছু পড়ে ফুক দিলাম। আমার অনুমান সত্য হলে কিছুক্ষণের মধ্যে ইনশাআল্লাহ জ্বর কমবে। জ্বর কমার পর খেতে চাইবে। আর
যদি তা না হয়, তা হলে তো কাল সকালে খবর দিতেই বললাম না।
চেয়ারম্যান প্রসঙ্গ পাল্টালেন। বললেন, বইরাপাড়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক হাফেজ ও মুফতি। সেদিন জুম্মার নামাযের পর আপনি যেসব কথা বলেছিলেন, একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বললেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমি বললাম, তা হলে আপনারা ঐসব করেন কেন? আপনারা এসবের প্রতিবাদই বা করেন না কেন? বললেন, অনেক আগে থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে অনেক ওলামায়ে কেরাম ও বোজর্গানেদ্বীন এই সব করে আসছেন। এর শিকড় এত গভীরে প্রবেশ করেছে যে, তা উৎপাটন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ যদি এসবের প্রতিবাদ করে, তা হলে ফিতনার সৃষ্টি হবে। বর্তমানে যারা বড় বড় আলেম, মুফতি ও বোজর্গানেদ্বীন আছেন, তাঁরা যদি এসব প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তা হলে ফিতনার সৃষ্টি হলেও বিস্তৃতভাবে কিছু হবে না এবং এসব কুসংস্কার সমাজ থেকে বিদূরিত হয়ে যাবে। আমাদের মতো ছোটখাটো আলেম বা মুফতিরা প্রতিবাদ করলে, সমাজে দলাদলির সৃষ্টি হবে। তাই জেনেশুনে আমাদের এইসব করতে হচ্ছে।