স্কুল ছুটির পর পারভেজ বাড়ি ফিরছিল। দূর থেকে বোনকে হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। কাছে এসে বলল, দেখলাম হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলি। কারো কিছু হয়ে থাকলে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতিস?
আতিকা বলল, না ভাইয়া, কারো কিছু হয় নি। এমনিই একটু আলাপ করছিলাম।
পারভেজ ভাবল, ওর নিজের কিছু অসুবিধের কথা হয়তো ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করছিল। বলল, চল, ঘরে চল।
যেতে যেতে আতিকা বলল, হাবিব ডাক্তার লোকটা কেমন বল তো?
পারভেজ হেসে উঠে বলল, ওঁকে তুই লোক বলছিস কেন? এখনও তো বিয়েই করেন নি। দাড়ি রেখেছেন বলে বয়স একটু বেশি দেখায়।
আতিকা অবাক হয়ে বলল, তাই না কী? আমি তো মনে করেছিলাম উনি তিন চারটে ছেলেমেয়ের বাপ।
পারভেজ আবার হেসে উঠে বলল, তোর আর দোষ দেব কি, গ্রামের অনেকেই ডাক্তারকে তাই মনে করে। আমিও আগে তাই মনে করতাম। একদিন হেডমাস্টারের কাছে তার সবকিছু জেনে খুব অবাক হয়েছিলাম। অবশ্য আমার সঙ্গে এখন ডাক্তারের ভালো সম্পর্ক।
হেডমাস্টার ওঁর সবকিছু জানলেন কি করে?
ততক্ষণে বাড়ির ভিতরে চলে এসেছে। পারভেজ বলল, এখন যা, পরে শুনিস। আসরের আজান হয়ে গেছে, নামায পড়ব।
০২. কুতুবপুর একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে কুতুবপুর একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কাটাবাগানপাড়া, বিশ্বাসপাড়া, খাঁপাড়া, দরগাতলা পাড়া, সূতাপাড়া, বইরাপাড়া, বাহাদুর পাড়া, মাঝপাড়া, পশ্চিমপাড়া, ভিটেপাড়া ও কামড়িপাড়া নামে এগারটা পাড়া নিয়ে এই গ্রাম। বিশ্বাসপাড়ায় কুতুবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মুনসীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বইরাপাড়ায় হাফেজিয়া মাদ্রাসা আছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গরিব ও কৃষিজীবী। ইদানিং নানারকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে অনেকের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে বিশ্বাসপাড়ার মানুষজনের অবস্থা আগের থেকে ভালো। কারো কারো একশ থেকে তিন চারশ বিঘে জমি-জায়গা আছে। মুশতাক বিশ্বাসের অবস্থা সবার থেকে ভালো। লেখাপড়া তেমন না জানলেও আর্থিক অবস্থার কারণে তিনি গ্রামের মাতব্বর। তার চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সেজ ছেলে পারভেজ ও ছোট মেয়ে আতিকা ছাড়া সবাই অল্প বয়সে মারা গেছে। পারভেজ বি.এ. পাশ করে গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে মাস্টারি করছে। তার বিয়ে হয়েছে। ছোট দুটো ছেলে মেয়েও হয়েছে। আতিকা তিন বছর আগে এস.এস.সি. পাশ করে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে। বিশ্বাসরা নিজ গোষ্ঠী ছাড়া অন্য গোষ্ঠীতে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয় না। এই নিয়ম পূর্ব পুরুষদের আমল থেকে চলে আসছে। তারা অন্য গোষ্ঠীকে ছোট জাত মনে করে। নিজ গ্রামের গোষ্ঠীদের মধ্যে উপযুক্ত পাত্র না থাকায় মুশতাক বিশ্বাস মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য অন্যান্য গ্রামে পাত্রের সন্ধানে ঘটক লাগিয়েছেন।
আতিকা অনিন্দ্য সুন্দরী। ঠিক যেন প্রস্ফুটিত পদ্ম। স্কুলে পড়ার সময় খাঁপাড়ার নাদের আলিকে তার খুব ভালো লাগত। তাই নাদের আলি পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। আজ পাঁচ ছয় বছর পরেও কেউ কাউকে ভুলতে পারে নি। বরং তাদের মনের টান আরো বেড়েছে।
খাঁপাড়ার মধ্যবিত্ত আব্বুর রশিদের পাঁচ মেয়ের পর এক ছেলে। সেই ছেলে নাদের আলি। আব্বুর রশিদ পাঁচ মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে পৈত্রিক সম্পত্তি যা ছিল, সবটা বিক্রি করেছেন। এখন বাস্তুভিটে ও তৎসংলগ্ন মাঝারি সাইজের একটা পুকুর ছাড়া আর কিছু নেই। তাই নাদের আলি ক্লাস এইটে ভালো রেজাল্ট করে নাইনে উঠলেও আর্থিক কারণে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে বাবার সঙ্গে লোকজনের গৃহস্থালী ও চাষ-বাসের কাজ করে। এখন সে বিশ বাইশ বছরের যুবক। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, বলিষ্ঠ শরীর, গায়ের রং ফরসা। খুব পরিশ্রমী ছেলে।
আতিকা ও নাদের আলি তাদের দুই বংশের শত্রুতা ও আর্থিক ব্যবধান জানা সত্ত্বেও দিনের পর দিন গভীর ভালবাসায় জড়িয়ে পড়েছে। আগে স্কুলে যাতায়াতের পথে একে অপরের সঙ্গে দেখা করত। এস.এস.সি পাশ করার পর আতিকা তাদের বাগান বাড়িতে নাদের আলিকে আসতে বলত। সেখানে তারা গোপন অভিসার করত। ব্যাপারটা অনেক দিন গোপন ছিল। একদিন মুশতাক বিশ্বাসের চাকর করিম জানতে পেরে আতিকার মা শাফিয়া বানুকে জানায়। তিনি কথাটা কাউকে জানাতে করিমকে নিষেধ করে দেন। তারপর একসময় মেয়েকে কথাটা জানিয়ে বললেন, “তোর আব্বা জানলে তোকে দু’খান করে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। আর নাদের আলিকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেবে। তুই তাকে আসতে নিষেধ করে দিবি।”
আতিকা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, নাদের আলি ভাইকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমরা একে অপরকে অনেক বছর ধরে ভালবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
মেয়ের কথা শুনে শাফিয়া বানু রাগ সামলাতে পারলেন না। যা জীবনে করেন নি, তাই করে বসলেন। ঠাস করে তার গালে একটা চড় মেরে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ভালবাসার কথা বলতে তোর লজ্জা করল না? আবার যদি ঐকথা মুখে উচ্চারণ করিস, তবে তোর একদিন কি আমার একদিন।
আতিকা ভাবতেই পারে নি মা মারবে। কারণ আজ পর্যন্ত মা তাকে মারা তো দূরের কথা, কখনও রাগারাগি করে নি। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, ঠিক আছে, মারলে যখন আরো মারো, মেরে মেরে আমাকে মেরেই ফেল। তবু বলব নাদের আলি ভাইকে আমি প্রাণের থেকে বেশি ভালবাসি। তাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব না। তোমরা যদি জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কর, তাহলে বিয়ের দিনে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করব।