শুনুন মাতব্বর সাহেব মুমীন মুসলমান হয়ে শুধু খায়েদের সঙ্গেই নয়, যে কোনো মানুষের সঙ্গে শত্রুতা থাকলে মিটিয়ে ফেলুন। নচেৎ কি হবে, তাতো কুরআন হাদিসের বাণীতে শুনলেন। আপনি হজুও করেছেন, বয়সও হয়েছে। পূর্ব পুরুষরা খায়েদের সঙ্গে যে শত্রুতার বীজ বপণ করে গেছেন, তা মিটিয়ে ফেললে, আপনার ও আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরদের ইহকালে ও পরকালে মঙ্গল হবে। এবং মরহুম পূর্বপুরুষদেরকেও আল্লাহ আপনার অসিলায় নাযাত দিতে পারেন।
কুরআন-হাদিসের বাণী শুনে মুশতাক বিশ্বাসের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হলেও বংশ মর্যাদার কথা ভুলতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বিশ্বাসদের মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তির তুলনায় খায়েরা অনেক ছোট। তুমিই বল, তাদের সঙ্গে কী আমরা আত্মীয়তা করতে পারি? নাদের আলির না আছে বংশ মর্যাদা, না আছে ধন-সম্পদ, কি দেখে তাকে আমরা জামাই করব। তুমি তো আমাদের অবস্থার কথা জান। আতিকা কত সুখে মানুষ হয়েছে। আমাদের ঐ একটাই মেয়ে। নাদের আলি কি তাকে সেইভাবে রাখতে পারবে? তা ছাড়া আমি গ্রামের পাঁচজনের কাছে মুখ দেখাব কি করে?
হাবিব ডাক্তর বলল, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। ইসলামেও কুফু অর্থাৎ সমপর্যায়ে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে বলা হয়েছে। তবে কুফুর ব্যাখ্যা অনেক। সে সব বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। তাই অল্পকিছু আলোচনা করছি। বিয়ের ব্যাপারে ছেলে বা মেয়ের বংশ ভালো না মন্দ অবশ্যই দেখতে হবে। যদি কোনো বংশের সমাজিক ও পারিবারিক জীবনে ধর্মের অনুশীলন থাকে, ছেলে বা মেয়ে ধার্মিক হয়, হালাল হারাম বেছে চলে এবং আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না হলেও মোটামুটি স্বচ্ছল, তা হলে তারা কুফুর অন্তর্গত। সেখানে বংশ মর্যদার কথা চিন্তা না করে ইসলাম আত্মীয়তা করতে বলেছে। সেক্ষেত্রে বংশের গৌরব খাটে না। নাদের আলির অনেক ধন-সম্পদ না থাকলেও তার কোনো অভাব নেই। ইদানিং জমি-জয়গা করেছে, নতুন বাড়ি করেছে। তা ছাড়া তার বাপ-চাচারা যথাসম্ভব ধর্ম কর্ম মেনে চলেন। সুদের ব্যবসা করেন না, মদ-তাড়ি খান না, তা নিশ্চয় আপনি জানেন।
মুশতাক বিশ্বাস দৃঢ়স্বরে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি। তবু নাদের আলির সঙ্গে আতিকার বিয়ে হবে না, হতে পারে না।
আপনি জানেন কিনা জানি না, ওরা কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় থেকে একে অপরকে পছন্দ করে। কথাটা শেষ করে মুশতাক বিশ্বাসের মুখের দিকে হাবিব ডাক্তার তাকিয়ে রইল চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় কিনা দেখার জন্য।
মুশতাক বিশ্বাসের মুখে রাগের চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখে হাবিব ডাক্তার আবার বলল, আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারের কথা বলে বোধ হয় আমি ভুল করে ফেললাম, মাফ করে দিন।
পারভেজ এতক্ষণ চুপ করে সবকিছু শুনছিল। কুরআন-হাদিসের বাণী শুনে তার মনও নরম হয়েছিল। পছন্দ করার কথা শুনে খুব রেগে গেল। রাগের সঙ্গে বলল, একথা বিশ্বাস করি না। আতিকা আমার বোন। তাকে আমার থেকে কেউ বেশি জানে না। সে কিছুতেই নাদের আলিরমতো একটা, হা-ভাতে ছেলেকে পছন্দ করতে পারে না।
হাবিব ডাক্তার তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পারভেজ ভাই, মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে খুব রেগে গেছেন। কথাটা বিশ্বাস না হলে, আপনার স্ত্রীকে দিয়ে আতিকার কাছ থেকে সত্য মিথ্যা জানতে পারবেন। তারপর মুশতাক বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, একটু আগে বললাম না, আতিকাকে আমি বোনের মতো মনে করি? তাই তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে নাদের আলির সবকিছু খোঁজ খবর নিই। একমাত্র আর্থিক দিক ছাড়া অন্য সবকিছুতে আতিকার উপযুক্ত। আপনার এক ছেলে এক মেয়ে। আপনি মারা যাওয়ার পর আতিকা অনেক সম্পত্তি পাবে। ইচ্ছা করলে বিয়ের সময় তাকে তার অংশ দিয়ে দিতে পারেন। তা হলে নাদের আলি গ্রামের ধনীদের একজন হয়ে যাবে। এতে করে আপনার সুনামও বাড়বে। ওদের কথাটা অনেকদিন থেকে আপনাকে জানাব ভেবেছিলাম, সময় সুযোগের অভাবে জানাতে পারি নি। আজ আপনি আতিকার বিয়ের কথা তুলতে বললাম। এখন আপনাদের মর্জি। এবার যাওয়ার অনুমতি দিন বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুশতাক বিশ্বাস গম্ভীরস্বরে বললেন, একটা কথার উত্তর দিয়ে যাও।
বেশ তো বলুন।
গত বন্যায় নাদের আলি পথের ভিখারী হয়ে গিয়েছিল, এই একদেড় বছরের মধ্যে কি করে এত উন্নতি হল বলতে পার?
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, তা আমি কি করে বলব? সে তো এই গ্রামের ছেলে। আপনাদেরই তো জানার কথা। তবে এতটুকু বলতে পারি, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি মুহূর্তে আমীরকে ফকির ও ফকিরকে আমীর করতে পারেন।
মুশতাক বিশ্বাস একইস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ওদের দু’জনের পছন্দের কথা তুমি জানলে কী করে? নিশ্চয় নাদের আলি বলেছে?
আমাকে বলার মতো সাহস নাদের আলির নেই। কে বলেছে জানতে চাচ্ছেন কেন? তারা যে এখনো দেখা সাক্ষাৎ করে, তা শুধু আমিই নই, গ্রামের অনেকেই জানে। সাহস করে কেউ আপনাকে জানাতে পারে নি। তাই বলছিলাম, কথাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার আগে ওদের বিয়ে দিয়ে দিলে চাপা পড়ে যেত। আপনাদের মান-সম্মানেরও হানি হত না। তারপর আসি বলে সালাম বিনিময় করে হাবিব ডাক্তার চলে গেল।
আতিকা ও নাদের আলির সম্পর্কের কথা শোনার পর থেকে পারভেজ রেগে রয়েছে। হাবিব ডাক্তার চলে যাওয়ার পর রাগের সঙ্গে আব্বাকে বলল, আপনি নাদের আলির সঙ্গে আতিকার সম্পর্কের কথা জানতেন?