যাক, আপনাদের অনেক সময় নষ্ট করলাম, সেজন্য মাফ চাইছি। আমার কথাগুলো যদি আপনাদের মনঃপূত না হয় অথবা বিশ্বাস না হয়, তা হলে কোনো হাক্কানী আলেম অথবা কোনো মুফতি সাহেবের কাছে থেকে জেনে নিতে পারেন। অথবা মুফতি মাওলানা ইবরাহিম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আর একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না, দেখলাম, অনেকে ক্ষীর (চালের পায়েস), জিলিপী ও বাতাসা শিনী হিসাবে নিয়ে এসেছে। এগুলো যদি তারা মানত হিসাবে এনে থাকে, তা হলে আমাদের মধ্যে যারা সাহেবে নেসাবের অধিকারী, তাদের খাওয়া না জায়েজ হবে। শুধু যারা গরিব ও সাহেবে নেসাবের অধিকারী নন, তারা খেতে পারবেন। এখন প্রচলিত প্রথামতো দোয়া না করে মাতব্বর সাহেবসহ আমরা প্রত্যেকে নিজে নিজে তাঁর মরহুম পিতার রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করি আসুন বলে হাবিব ডাক্তার দু’হাত তুলে অনুচ্চস্বরে দোয়া করতে লাগল।
হাবিব ডাক্তারকে গ্রামের সবাই, বিশেষ করে গরিব অশিক্ষিতরা পীরের মতো মনে করে। তাই তাকে দোয়া করতে দেখে তারাও যখন হাত তুলে দোয়া করতে লাগল, তখন অন্যরাও তাই করতে লাগল।
খাওয়া-দাওয়ার পর পারভেজকে নিয়ে মুশতাক বিশ্বাস আলাপ করার সময় হাবিব ডাক্তারকে বললেন, মসজিদে আপনার কথা শুনে অনেকে নানারকম কথা বলছে, অনেকে আপনার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। যাক ওসব কথা, আপনাকে আসতে বলেছি একটা কথা বলব বলে। আপনি যদি মনে কিছু না করেন, তা হলে বলতে পারি।
মুশতাক বিশ্বাস এতদিনে তাকে তুমি সম্বোধন করে এসেছেন। আজ সকালেও বলেছেন। এখন আপনি করে বলতে শুনে হাবিব ডাক্তার বেশ অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বলল, আপনি মুরুব্বী মানুষ। এতদিন ছেলের মতো মনে করে আমাকে তুমি করে বলে এসেছেন, এখন আবার আপনি করে বলছেন কেন? তুমি করে বললে খুশি হব। আর আপনার কথা শুনে কিছু মনেই বা করব। কেন? নিশ্চিন্তে বলুন।
হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। এতদিন তোমাকে ছেলের মতই দেখে এসেছি। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, আমার মেয়ে আতিকাকেতো খুব ভালো করেই চেনো। ওর জন্য অনেক পাত্র দেখেছি, কিন্তু উপযুক্ত কাউকেই পাই নি। এই এলাকায় আসার পর থেকে তোমার সবকিছু দেখে শুনে আমরা আতিকার জন্য তোমাকে পছন্দ করেছি। কথা শেষ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাবিব ডাক্তার এই কথা শোনার জন্য অনেকদিন থেকে অপেক্ষা করছিলেন। তাই মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আমার সম্পর্কে কতটুকু জেনেছেন জানি না, আমি কিন্তু বিবাহিত। আমাদের বংশ হল খাঁ। আমাদের বংশের নিয়ম হল, খ বংশ ছাড়া অন্য বংশে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় না। আমি অবশ্য এই নিয়ম মানি না। তাই অন্য বংশে বিয়ে করেছি।
তার কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাস অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু আমরা তো জেনেছি তুমি এখনো বিয়ে কর নি? তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিও তো একদিন তাই বলেছিলে?
পারভেজ কিছু বলার আগে হাবিব ডাক্তার বলল, আপনারা ঠিক কথাই শুনেছিলেন। মাত্র চার-পাঁচ মাস আগে যে বিয়ে করেছি। তাই এখানকার কেউ এখনো জানে না।
মুশতাক বিশ্বাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া করেছেন, তার সঙ্গেই তার বিয়ে হয়। তা বাবা, তোমার বাড়ি তো ঢাকায়, সেখানে তোমার জানাশোনা কোনো ভালো ছেলে থাকলে আতিকার জন্য একটু চেষ্টা করে দেখ না। দরকার মনে করলে ওর কয়েকটা ফটো তোমাকে দেব।
ওসবের দরকার নেই। আমি আতিকাকে বোনের মতো মনে করি, তাই আগে থেকে ওর জন্য আপনাদের গ্রামেরই একটা ছেলেকে পছন্দ করে রেখেছি।
মুশতাক বিশ্বাস বেশ অবাক হলেও গম্ভীর স্বরে বললেন, ছেলেটা কে?
খাঁপাড়ার নাদের আলি। বেশি লেখাপড়া না করলেও খুব ভালো ছেলে। রুগী দেখতে আশপাশের সব গ্রামেই গেছি, নাদের আলির মতো এত ভালো ছেলে আর দেখি নি। যেমন স্বাস্থ্য তেমনি…..।
মুশতাক বিশ্বাস হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে খুব রাগের সঙ্গে বললেন, কী বলছ তুমি ডাক্তার? ঐ ছোটলোকের বাচ্চার কথা আর মুখে আনবে না। দাওমতো পেলে ওকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেব।
তার রাগের কারণ হাবিব ডাক্তার জানে। তাই ভনিতা করে বলল, নাদের আলিকে ছোটলোকের বাচ্চা বলছেন কেন? আমি তো জানি খায়েরা খুব খান্দানী বংশ। আগে আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল। এখন না হয় গরিব হয়ে গেছে।
মুশতাক বিশ্বাস এবার খুব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তুমি মাত্র এক দেড় দু’বছর হল এই এলাকায় এসেছ। খায়েদের সম্পর্কে আর কতটুকু জেনেছ? খাঁ বংশটাই ছোটলোক।
কিন্তু আমি তো তাদের কোনো ছোটলোকী কাজ কারবার দেখি নি। যদি তারা সে রকম হত, তা হলে নিশ্চয় কিছু না কিছু বুঝতে পারতাম।
মুশতাক বিশ্বাস গরম মেজাজে বললেন, ওদের কথা আর বলো না। যা জান না, তা নিয়ে কথা বলতে চাই না। শুধু একটা ব্যাপার বলছি, পূর্বপুরুষ থেকে খায়েদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা। আর বিশ্বাস গুষ্টি ছাড়া আমরা অন্য গুষ্টির সঙ্গে আত্মীয়তা করি না।
হাবিব ডাক্তার বললেন, বেয়াদবি নেবেন না, এ ব্যাপারে আমি দু’একটা কথা বলতে চাই। অবশ্য আপনি যদি অনুমতি দেন।
মুশতাক বিশ্বাস অসন্তুষ্টকণ্ঠে বললেন, বল কী বলতে চাও।
পূর্বপুরুষ থেকে খায়েদের সঙ্গে আপনাদের শত্রুতার কারণ আমি জানতে চাই না। তবে এখনও সেই শত্রুতা জিইয়ে রাখা কোনো পক্ষেরই উচিত হয় নি। কারণ, কুরআনে আল্লাহ বলিয়াছেন, “এক মুমীন অন্য মুমীনের ভাই।”[ বর্ণনায় হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ) মুসলিম।] আর হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, “এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। তাহাকে সে অত্যাচার করে না, অপমান করে না। এবং (বুকের দিকে ইঙ্গিত করিয়া) এইস্থানে অবস্থিত তাহার ধর্মভীরুতাকে অবজ্ঞা করে না। মুসলমান ভাইকে অবজ্ঞা করার জন্য যে পাপ হয়, উহার বিবেচনায় তিনি তিনবার স্বীয় বুকের দিকে ইঙ্গিত করিলেন। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য হারাম। তাহার জান-মাল এবং তাহার সমান।” তিনি আরো বলেছেন, “তিনদিনের অতিরিক্ত কোনো মুসলমানের পক্ষে তাহার ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করিয়া থাকা হালাল নহে। যে তিন দিবসের অতিরিক্ত তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে অতঃপর তাহার মৃত্যু হয়, সে দোযখে যাইবে।”[ বর্ণনায় হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ)—আহম্মদ, আবু দাউদ।] হাদিসে আরো আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার বেহেস্তের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। তখন শিরক (অংশীবাদী) ভিন্ন প্রত্যেক লোককে ক্ষমা করা হয়। যে দুইজনের মধ্যে বিবাদ থাকে, তাহাদিগকে ক্ষমা করা হয় না। উহাদিগকে বলা হয়, যে পর্যন্ত মীমাংসা না কর, সেই পর্যন্ত অপেক্ষা কর।”[ বর্ণনায় হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ)-মুসলিম।]