জানা দরকার যে, দোয়া হল নফল কাজ এবং নফল আমলের ব্যাপারে শরীয়তভিত্তিক স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হল, একক ও গোপনভাবে করা। যৌথ ও প্রকাশ্যভাবে নয়। অর্থাৎ প্রত্যেক নফল কাজ গোপনভাবে এবং একাকীভাবে করাই হল শরীয়তের দাবি ও হুকুম। জামায়াতবদ্ধভাবে ও প্রকাশ্যভাবে নয়।
মাজহাবে হানাফির সুপ্রসিদ্ধ ও একমাত্র নির্ভরযোগ্য কিতাব হিদায়ার মধ্যে আছে, দোয়ার প্রকৃত নিয়ম হল গোপনীয়তা অবলম্বন করা; কিন্তু এস্তেসকার (বৃষ্টি বর্ষণ) ও কুসুফের (চন্দ্র গ্রহণ) নামাযের ব্যতিক্রম। এই দুটি নামায যদিও বা নফল, কিন্তু যেহেতু এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে সম্মিলিত ও প্রকাশ্যে করার প্রমাণ রয়েছে। কাজেই উক্ত নামায জামায়াত ভিত্তিক প্রকাশ্যভাবে আদায় করতে হবে এবং এরপর দোয়াও সম্মিলিতভাবে হাত উত্তোলন করে করতে হবে। কেননা নবীয়ে করিম (দঃ) থেকে এমনিভাবে করার প্রমাণ রয়েছে। পক্ষান্তরে অন্য কোনো নফল ইবাদতের মধ্যে সম্মিলিত এবং প্রকাশ্যে করার নিয়ম নেই। বলাবাহুল্য যে, হুজুর (দঃ) এর নবুয়তী জিন্দেগীর তেইশ বছর পর্যন্ত দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ইমামতীর কাজ নিজেই সম্পন্ন করেছেন। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে যদি মুক্তাদীগণসহ একবারও ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দোয়া করতেন, (যা বর্তমানে করা হয়), তা হলে অবশ্যই সমস্ত বর্ণনাকারীগণ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বর্ণনা করার প্রয়াস পেতেন। বর্তমানে দোয়া প্রমাণ করার জন্য কিয়াসের প্রয়োজন হত না। কিন্তু সহিহ, দুর্বল তো দূরের কথা, একটা মউজু (মনগড়া) দ্বারা বিশেষ আকারে প্রচলিত মোনাজাতের প্রমাণ যেমন হুজুর (দঃ) এর কাছ থেকে পাওয়া যাই নি, তেমনি সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ), তাবেয়িন (রঃ) আজমায়ে মুজতাহিদীগণের থেকেও তার কেশাগ্র পরিমাণও প্রমাণ নেই।
যে সমস্ত হযরাতে কেরামগণ উক্ত বিশেষ আকারে মোজাত করাকে মুস্তাহাব বলেন, তাদের যুক্তিভিত্তিক দলিল হল, “তারা বলেন, রেওয়ায়েত আছে। ফরয নামাযের পর দোয়া কবুল হয় এবং কতক দোয়ার মধ্যে হুজুর (দঃ) থেকে হাত উঠানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং বিশেষ আকারে এ দোয়া ও মোনাজাত সুন্নত হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ দলিল ও যুক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘হাবায়াম মানসুরা’ অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত ধূলিকণার মতো সম্পূর্ণ দুর্বল ও অসার বই কিছুই নয়। তাদের এই কিয়াসের শরীয়তের নিকট কোনো মূল্য নেই। এ সাধারণ জ্ঞানতো প্রায় সকলেরই আছে যে, যেখানে পরিষ্কারভাবে শরীয়তের দলিল বিদ্যমান ফরয নামাযের পর হুজুর পাক (দঃ) কি করেছেন, তা হরফে হরফে প্রতিটি অবস্থা বর্ণনা সুরক্ষিত। সেখানে অনুমানভিত্তিক অসার কিয়াসের কোনো মূল্য নেই, থাকতেও পারে না। যদি তা মেনে নেয়া হয়, তা হলে আর দ্বীন থাকবে না। তওরাত, ইঞ্জিল, ইত্যাদির মতো দ্বীন বিকৃত হয়ে যাবে। বরং শরীয়তভিত্তিক স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হল, যতটুকু আমল করার প্রমাণ পাওয়া যায়, ততটুকুরই আনুগত্য করা। আর যার প্রমাণ নেই, তা পরিত্যাগ করা।
হুজুর পাক (দঃ) অন্ধকার রাত্রে গোপনীয়ভাবে কোথায় কি করেছেন, তাও অনুসন্ধান করে সাহাবাগণ (রাঃ) ভবিষ্যৎ উম্মতের জন্য বর্ণনা করে দিয়েছেন। নবী করিম (দঃ) এর চাল-চলনের প্রতিটি অবস্থাই বর্ণনাকারীগণ অতি যত্নের সাথে বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে প্রকাশ্যকৃত গুরুত্বপূর্ণ কাজের বর্ণনা থাকবে না, তা সম্পূর্ণ অসম্ভব ও অবান্তর কথা।”
মোনাজাতের ব্যাপারে যা কিছু বললাম, তা মাওলানা মুফতি ইবরাহিম খান রচিত “শরীয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার বই থেকে।”
একটা কথা প্রতিটি মুসলমানের জেনে রাখা উচিত, যে কোনো কাজ বা প্রথার যদি অকাট্য দলিল না থাকে এবং এ জাতীয় নতুন কাজ বা প্রথা দ্বীনের হেফাজত বা নির্ভরশীল না হয়, আর সেটাকে ইবাদত বা সওয়াবের কাজ বলে মানুষ মনে করে, তা হলে এসব বেদায়াতে সাইয়্যেহা অর্থাৎ মাকরুহে তাহরীমা হবে। আরো একটা কথা জানা উচিত, ইসলামের সবকিছু পরিপূর্ণ করার কথা হযরত নবী করিম (দঃ) বিদায়ী হজ্বের নয় তারিখে শুক্রবার আরাফাতের ময়দানে লক্ষাধিক পবিত্র আত্মা তথা সাহাবাগণের (রাঃ) সম্মিলিত সমাবেশে আসরের পর আয়াতে করিমা অবতীর্ণের মাধ্যমে আল্লাহ পাক ঘোষণা করলেন—”আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করিয়া দিলাম। আর আমি তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে ইমলামকেই পছন্দ করিলাম।”[ সূরা-মায়িদাহ, ৩নং আয়াতের শেষের দিকের অংশ, পারা—৬।] হাদিসে আছে, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, আমাদের এই ধর্মে যাহা নাই এমন কোনো নতুন বিষয় যদি কেহ প্রবর্তন করে, সে অভিশপ্ত।”[ বর্ণনায় : হযরত আয়েশা (রাঃ) বুখারী, মুসলিম।] হাদিসে আরো আছে, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, নিশ্চয়ই সর্বাপেক্ষা উত্তম বাণী আল্লাহর কুরআন এবং সর্বাপেক্ষা উত্তম হেদায়েত (পথ প্রদর্শন) মুহাম্মদের হেদায়েত, সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট ব্যাপার নব-বিধান এবং প্রত্যেক নব-বিধানই বেদায়াত (পথ-ভ্ৰষ্টকারী)।”[ বর্ণনায় : হযরত যাবের (রাঃ)—মুসলিম।] এরপরও কি ইসলামে যার কোনো অকাট্য দলিল নেই, সেই সব নব-বিধান আমাদের মেনে চলা উচিত?