ত্যাগ করার কারণ যেহেতু তেলাওয়াতকারী ও এর আমন্ত্রণকারী হয়েছে। তাই। গুনাহগার তারাই হবেন। কেননা ঐ সমস্ত লোক শ্রবণ থেকে মাজুর।
আলমগীর কেতাবে আছে, “ফিকাহের কিতাব লেখায় মগ্ন ব্যক্তির নিকট যদি কেউ কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করে আর কিতাব লেখার কারণে তার জন্য শ্রবণ করা সম্ভব না হয়, তা হলে তেলওয়াতকারীই গুনাহগার হবে, লেখকের কোনো গুনাহ হবে না। এমনিভাবে রাত্রিবেলায় ঘরের ছাদের উপর যদি কেউ উচ্চস্বরে কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করে, তা হলে সে গুনাহগার হবে। এ বর্ণনাটুকু আলোচ্য বিষয়ের সাথে মিল রাখে। হযরত আবদুল্লাহ বিন অমর এর বর্ণনা—মিশকাত শরীফ: “তিন দিনের কমে যে কুরআন খতম করে সে কুরআনের অর্থ বুঝে নাই। মিশকাত শরীফের টীকায় আল্লামা তিবি (রঃ) থেকে বর্ণিত।” সিদ্ধান্তমূলক কথা হল, কুরআন মজিদ খতম করার ব্যাপারে চল্লিশ দিনের বেশি বিলম্ব করা এবং তিনদিনের কমে শেষ করা উভয়টাই মাকরুহ।
যে সমস্ত বুজুর্গগণ একরাত্রে ও একদিনে কুরআন খতম করেছেন বলে প্রসিদ্ধ, তা ছিল সাধনামূলক। তাও আবার অতি গোপনে ও নির্জনে, প্রকাশ্যে নয়। এটা ছিল প্রভুর প্রগাঢ় ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। দাওয়াত গ্রহণ করে টাকার বিনিময়ে ছিল না। খুবই বুঝার বিষয়। আবার মাইকে পড়ার মধ্যে দ্বিগুণ গুনাহ হবে। কেননা ঐ সময় মনোযোগের সাথে শ্রবণ করা সকলের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। অথচ শ্রবণ করা ওয়াজিব। সুতরাং শবিনা খতম নিঃসন্দেহে বিদয়াত সাইয়্যেয়া এবং মাকরুহে তাহরীমা বিধায় ইহা পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। এবং সামর্থ শক্তি অনুসারে প্রত্যেক দায়িত্ববান আলেমের জন্য এর প্রতিরোধ করা ওয়াজিব।
যেহেতু অধিকাংশ হাফেজই অন্ধ ও গায়বে আলেম বিধায় কুরআন হাদিস ও ইলমে ফিকাহ বুঝতে তারা সম্পূর্ণ অপারগ। টাকার লোভে তারা আখেরাতের ব্যাপারে আরো অন্ধ হয়ে যায়। তাকওয়া পরহেজগারীও তেমন থাকে না। অথচ ইসলামে সওয়াব হিসাবে খতমে শবিনা পড়ে পারিশ্রমিক নেয়া ও দেয়া উভয়ই হারাম। পবিত্র কালামে তার সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। “আমার কুরআন অল্প মূল্যে বিক্রি করিও না।” [সূরা মায়েদাহ, ৩৪নং আয়াতের শেষের দিকের অংশ, পারা—৬।]
উক্ত আয়াত তেলওয়াত করে সঠিক অর্থ বুঝার ব্যাপারে অন্ধ। স্বল্প মূল্যের অর্থ তাফসীরে খাজেনে বলা হয়েছে, দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যাবতীয় সম্পদ। পবিত্র হাদিসে আছে “তোমরা বিনিময় ব্যতীত কুরআন তেলওয়াত কর।” ফতোয়ায়ে শামীতে আছে “দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই গুনাহগার হবে।”—৫নং খণ্ড ৪৫ পৃষ্ঠা।
খতমে শবিনা নাজায়েজ সম্পর্কে মুসলিম শরীফে আছে, “হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হুজুর পাক (দঃ) একরাত্রে সমস্ত কুরআন তেলওয়াত করিয়াছেন। এবং সমস্ত রাত্রি ব্যাপী নামায পড়িয়াছেন বলে আমার জানা নেই। রমযান ব্যতীত অন্য কোনো সময় পূর্ণ মাস রোযা রাখেন নাই।”
সত্যায়িত
মুফতিয়ে আজম ফায়েজ উল্লাহ সাহেব (রঃ)।
শবিনা খতমের ব্যাপারে এতক্ষণ যা বললাম, মুফতি মুঃ মাওলানা ইব্রাহিম খান রচিত “শরিয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার বই এর ১৭৫ পৃষ্ঠা থেকে ১৭৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।”
আমাদের দেশে চাল্লিশা বা মৃত্যুবার্ষিকী বা মরহুম পিতা-মাতা ও মুরুব্বীদের নামে বছরে একবার যে ওরশ করে দোয়া খায়ের করা হয়, এটারও অকাট্য দলিল নেই। আর তিন স্বর্ণযুগেও ছিল না। আপনারা শুনে অবাক হবেন, ভারত, বাংলাদেশে ও পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে মিলাদ শরীফ পড়ান ও এইসব জিনিসের প্রচলন নেই। এমন কি মক্কা-মদিনাতেও নেই। এখন চিন্তা করে দেখুন, আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে যেভাবে ধুমধামের সঙ্গে মৃত্যুবার্ষিকীর জন্য মিলাদ বা ওরশ ও দোয়ার ব্যবস্থা আমরা যে করে থাকি, তা কি ঠিক? আর এরকম এতকিছু করার পিছনে যদি মান-সম্মানের উদ্দেশ্য জড়িত থাকে, তা হলে তো এই সব কিছু আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। আসলে মরহুম মুরুব্বীদের রুহের মাগফেরাতের জন্য যদি ছেলেমেয়েরা কিছু করতে চান, তা হলে বছরের যে কোনো দিন গরিব মিসকীনদের খাওয়াবেন, তাদেরকে জামাকাপড় দান করবেন, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ গরিব থাকলে তাদেরকে সবার আগে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করবেন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করবেন অথবা গরিবদের উন্নতির জন্য উৎপাদনমূলক কোনো প্রতিষ্ঠান করে ওয়াকফ করে দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করার ব্যবস্থা করবেন। আর দিনে হোক বা রাতে হোক নির্জনে একাকী কেঁদে কেঁদে এই সমস্ত কাজের অসিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে তাদের মাগফেরাতের দোয়া করবেন। একটা কথা জেনে নিন, দোয়া হল নফল ইবাদত। নফল ইবাদত দিনে হোক, রাতে তোক গোপনে করতে হয়। এই রকম জামায়াতবদ্ধ হয়ে লোক দেখান দোয়া করার কোনো অকাট্য দলিল নেই। এমন কি ফরয নামাযের পর জামায়াতের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মোনাজাত করারও কোনো অকাট্য দলিল নেই। এ সম্পর্কে মুফতি ইবরাহিম খান রচিত “শরীয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার” বই-এর ১৪০ পৃষ্ঠার শেষ পরিচ্ছদ থেকে ১৪২ পৃষ্ঠার শেষ লাইনের উপর পর্যন্ত লেখা আছে, “আর জানা আবশ্যক, হাল জামানায় মানুষের মধ্যে ফরয নামাযের পর এক বিশেষ মোনাজাতের প্রচলন প্রসিদ্ধ। ইহাতে ইমাম মোক্তাদী সকলেই একসাথে হাত উত্তোলন করে এবং মোক্তাদীগণ আমিন আমিন বলতে থাকে। মোনাজাতের শেষ লগ্নে আল্লাহুম্মা আমিন ইয়া আরহামার রাহেমীন বলে দোয়া শেষ করে। এটাকে নামাযের মোনাজাত বলে। অনেক এলাকায় নামাযের পর মুসুল্লীগণ বসে থাকে, সুন্নত নামাযসমূহ শেষ হলে সকলে দোয়ায় মশগুল হয়। ইহাকে আখেরী মোনাজাত বলে। অথচ এ জাতীয় দোয়া হযরত নবী করিম (দঃ), খোলাফায়ে রাশেদীন ও আম্বিয়ায়ে মুজতাহিদীনগণ থেকেও কোনো দলিল বা নজীর কিছুতেই পাওয়া যায় নি। এর সম্পর্কে সহিহ তো দূরের কথা, কোনো দুর্বল হাদিসও নেই। যা অনুসন্ধানকারীগণের নিকট গোপন নয়।