গ্রামের লোকজন সবাই তাকে চেনে। কয়েকজন দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, ডাক্তার সাহেব যে, আসেন আসেন।
হাবিব ডাক্তার সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? এত রান্নাবান্না কিসের?
তাদের একজন বলল, সেকথা পরে শুনবেন। এখন চলুন বৈঠকখানায় বসবেন।
পারভেজ বাবুর্চিদের সঙ্গে কথা বলছিল। তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, আসুন আমার সঙ্গে।
যেতে যেতে হাবিব ডাক্তার বলল, কী ব্যাপার বলুন তো? এত আয়োজন কি জন্য?
আজ আমার দাদাজীর মৃত্যুবার্ষিকী। আপনি এসেছেন, আব্বা খুব খুশি হবেন। আপনার আসতে দেরি দেখে একটু আগে আব্বা কার্পাসডাঙ্গায় যেতে বলছিলেন। বৈঠকখানায় এসে বলল, বসুন, আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসছি।
একটু পরে মুশতাক বিশ্বাসকে আসতে দেখে হাবিব ডাক্তার দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে মুশতাক বিশ্বাস বললেন, ভালো। তারপর তাকে বসতে বলে নিজেও একটা চেয়ারে বসে বললেন, শুনলাম ঢাকা গিয়েছিলেন, কবে ফিরলেন?
তিন চারদিন হল।
ওখানকার, মানে তোমাদের বাড়ির সব খবর ভালো?
মুশতাক বিশ্বাস তাকে যে একটু বাঁকা চোখে দেখেন, তা হাবিব ডাক্তার জানে। তাই আজ তার কতাবার্তায় আন্তরিকতা দেখে একটু অবাক হল। বলল, জি, সব খবর ভালো।
এমন সময় পারভেজ কয়েক পদের নাস্তা নিয়ে এলে মুশতাক বিশ্বাস বললেন, নাস্তা খেয়ে ওর সঙ্গে গল্প কর। জেনেছ বোধহয়, আজ পারভেজের দাদাজীর মৃত্যুবার্ষিকী। মসজিদে শবিনা খতম হচ্ছে। জুম্মার নামাযের পর বখশানো হবে। দুপুরে গ্রামের লোকজনদের খাওয়ান হবে। সবকিছু দেখাশোনা করতে হচ্ছে। এখন যাই, পরে আপনার সঙ্গে একটা জরুরী আলাপ করব।
কুতুবপুর গ্রামের মধ্যে বিশ্বাসপাড়ায় জুম্মা মসজিদ। তাই গ্রামের সবাই এখানে জুম্মার নামায পড়তে এসেছে। বইরাপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার চারজন শিক্ষক ও ছাত্ররাও এসেছে। জুম্মার নামাযের শেষে মিলাদ ও দোয়া দরুদ পড়ার পর বখশানোর সময় ইমাম সাহেব, হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক যিনি হাফিজ ও মুফতি, তাকে দোয়া করার কথা বললে তিনি আবার ইমাম সাহেবকেই দোয়া করতে বললেন।
হাবিব ডাক্তার মাঝখান থেকে বলে উঠল, আপনারা বেয়াদবি নেবেন না। আমার মনে হয় মাতব্বর সাহেবরই দোয়া করা উচিত।
হাবিব ডাক্তারের কথা শুনে সমস্ত মুসুল্লী অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। মসজিদের ভিতর ও বাইরে কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করতে লাগল।
এবার হাবিব ডক্তার দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আপনারা কেউ কিছু বলছেন না কেন, আমি কি ভুল কিছু বলে ফেললাম?
আজরাফ হোসেন জানেন, হাবিব ডাক্তার ধর্মের প্রচুর জ্ঞান রাখেন। নিশ্চয় এ ব্যাপারে কিছু বলতে চান। তাই কেউ কিছু বলার আগে বললেন, কিন্তু এখানে বেশ কয়েকজন হাফেজ ও আলেম রয়েছেন, তাঁদের উপস্থিতিতে সাধারণ একজন মানুষের দোয়া করা কি ঠিক হবে?
হাবিব ডাক্তার বলল, আমি জানি অন্যান্য ইবাদতের মতো দোয়া করাও একটা ইবাদত। শুধু তাই নয়, হাদিসে আছে, নবী (দঃ) বলেছেন, “প্রার্থনা (দোয়া) ইবাদতের মজ্জা (মূল)।” [বর্ণনায় হযরত আনাস (রাঃ)-তিরমিযী।] তা হলে চিন্তা করে দেখুন, সেই দোয়া নিজে না করে হাদিয়া-তোফা দিয়ে অন্যকে দিয়ে কি করান উচিত? তা ছাড়া যে উদ্দেশ্যে মাতব্বর সাহেব এই দোয়ার আঞ্জাম করেছেন, তাঁরই তো করা উচিত। কারণ নিজের মরহুম আব্বার ও মুরব্বীদের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করার সময় ওঁর দিল যতটা কাঁদবে, অন্য কারো দিল কী ততটা কাঁদবে? আরো দু’একটা কথা না বলে পারছি না, মৃত্যুবার্ষিকী বলে ইসলামে কোনো দলিল নেই। যদি থাকত, তা হলে সাহাবীরা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (দঃ)-এর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতেন। মনে রাখবেন, ইসলামের যে সব জিনিসের কোনো অকাট্য দলিল নেই, সেই সব কাজ যদি সওয়াবের আশায় করা হয় এবং তা সমাজে প্রচলিত হয়ে যায়, তা হলে তাকে বেদয়াত বলে। এই যে মাদ্রাসার উস্তাদ ও ছাত্রদের দিয়ে কুরআন খতম করান হয়েছে, নিশ্চয় তাদেরকে টাকা-পয়সা। নজরানা বা হাদিয়া দেবেন। এটা ও ইসলামে জায়েজ নয়। আলেম, হাফেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রদের নজরানা বা হাদিয়া দেয়া খুব সওয়াবের কাজ, এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এসব দেয়াও ধনীদের উচিত। কিন্তু ঐসব দিয়ে তাদের দ্বারা কুরআন খতম করান বা দোয়া করান মোটেই উচিত নয়। কারণ এসব আল্লাহর কাছে কবুল হবে না বরং এই টাকা-পয়সা দেয়া নেয়াও না-জায়েজ হবে। প্রচলিত খতমে শবিনা সম্পর্কে মুফতি মুঃ ইবরাহীম খান, খাদেম মেখল হামিউসসুন্নাহ মাদ্রাসা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, তার লিখিত শরীয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার বইতে লিখেছেন, “খতমে শবিনা এবং শবিনা খতম মানে, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই দুই তিনজন হাফেজ সাহেব মিলে, পালাক্রমে একরাতে কুরআনের খতমের প্রথা দেখা যায়। এটা ধর্মের কিছুই নয়, বরং বিদআতে সাইয়্যেয়াহ এবং মাকরূহে তাহরীমা। কেননা কুরুনো সালাসায় (তিন স্বর্ণযুগ)-এ বিশেষ পদ্ধতিতে খতমের কোনো নাম গন্ধও ছিল না। ইবাদতের আকারে ইহা সম্পূর্ণ একটি নতুন কাজ। হুজুর (দঃ) ফরমান—এবং গায়রে দ্বীনকে দীন মনে করা এবং ইহা সাওয়াবের কাজ বলে বিশ্বাস করা অবশ্যই সীমা অতিক্রম করা। কুরআন-হাদিসে অকাট্য দলিল হল,….”সাধারণভাবে কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করা হল মুস্তাহাব। আর ইহা শ্রবণ করা ওয়াজিব।” আল্লাহ কুরআন মজিদে বলেছেন, “আর যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন মনোনিবেশের সহিত উহা শ্রবণ করিও এবং চুপ থাকিও, যেন তোমাদের উপর রহমত বর্ষিত হয়।”[সূরা-আল আরাফ, আয়াত—২০৪, পারা—৯।] সর্বাবস্থায় সকলের জন্য কুরআন তেলাওয়াত শ্রাবণ করা, বিশেষ করে যারা মাজুর, রোগী বা প্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্তশীল, তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অথচ শ্রবণকারী মাত্রই শ্রবণ করা ওয়াজীব। সুতরাং শ্রবণ