বিকেলে গিয়াসের বাড়িতে গিয়ে তার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা বলতো শুনি।
ঘটনা যা কিছু ঘটেছিল গিয়াস সে সব বলে বলল, নাদের আলির কেউ কখনও এতটুকু ক্ষতি করতে পারবে না। তার বাড়িতে জিন থাকে। যারা যাবে তাদের অবস্থা আমার মতই হবে।
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, তোমার দলবলের সবার কী একই অবস্থা হয়েছে?
না, তারা জিনটাকে দেখে আগেই দৌড় দিয়েছিল। আমি পিছনে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই জিনের লাঠির বাড়ি আমার উপরেই পড়েছে।
মুশতাক বিশ্বাস চিন্তিত মুখে বললেন, ওদের বাস্তুতে জিন থাকে কই, তাতো কখনো শুনি নি? বাপ-দাদাদের মুখেও শুনি নি। তুমি হয়তো ভুল দেখেছ।
ভুল দেখি নি মাতব্বর সাহেব। পাঁচ ব্যাটারীর টর্চ জ্বেলে দেখেছি। তা ছাড়া সঙ্গে যারা ছিল, তারাও কী ভুল দেখেছে?
মুশতাক বিশ্বাস চিন্তিত মুখে বললেন, তা হলে নাদের আলিকে শায়েস্তা করবে কী করে?
গিয়াস বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, আমি তাকে শায়েস্তা করতে পারব না। একটা লাঠির ঘা মেরে জিনটা বলল, আবার যদি নাদের আলির কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করিস, তা হলে তোকে একবারে জানে শেষ করে দেব। তাই ভেবেছি, আর কারো ক্ষতি করার মতো কাজ আর করব না। নিজের যতটুকু আছে তাতে গতর খাটিয়ে একবেলা একসন্ধে খেয়ে হলেও সংসার চালাব।
তার কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাস বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তোমার সঙ্গে কারা গিয়েছিল?
আমার চাচাত ভাই রফিক আর চারজন কামড়ীপাড়ার লাঠিয়াল, তারপর তাদের নাম বলল।
মুশতাক বিশ্বাস গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, পা প্লাস্টার করল কে?
হাবিব ডাক্তার।
সে তো ঢাকায় গিয়েছিল শুনেছিলাম? ফিরল কবে?
তাতো জানি না। সকালে লতিফকে কার্পাসডাঙ্গায় পাঠিয়েছিলাম তাকে ডেকে নিয়ে আসতে। দুপুরের আগে এসেছিলেন।
মুশতাক বিশ্বাস আর কিছু না বলে ফিরে এসে রসুকে কামড়ীপাড়ায় পাঠালেন, ঐ চারজন লেঠেলকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য।
সন্ধ্যের পর তারা এলে মুশতাক বিশ্বাস তাদের কাছে ঘটনাটা জানতে চাইলেন।
গিয়াস যা যা বলেছিল, লেঠেলরাও তাই বলল। আরো বলল, আমরা আর কোনো দিন নাদের আলির ক্ষতি করার চেষ্টা করব না।
গিয়াসের কথা মুশতাক বিশ্বাস, বিশ্বাস করতে না পেরে তার সঙ্গী লেঠেলদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তারাও যখন একই কথা বলল তখন বিশ্বাস
করে পারলেন না। তাদেরকে বিদায় করে রসুকে বললেন, নাদের আলিকে মেরে তার হাত-পা ভেঙে দেয়ার জন্য গিয়াস এদেরকে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর যা ঘটেছে, সবকিছু তো শুনলে, তুমি চেষ্টা করে দেখবে না কী?
রসুর বাড়ি দরগাতলা পাড়ায়। মুরব্বীদের মুখে শুনেছে, এখানে কোনো এক পীরের দরগা ছিল। তখন গভীর রাতে ঐ দরগায় অনেক জিন যাতায়াত করত। এখন দরজা না থাকলেও জিনদেরকে ঐ এলাকায় যাতায়াত করতে অনেকে দেখেছে। একবার রসুর এক দাদা গভীর রাতে প্রকৃতির ডাকে ঐদিকে গিয়েছিল। তাকে নাকি জিনেরা মেরে ফেলে। সকালে সেখানে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে ঐ জায়গাটা বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। রসু তখন আট-দশ বছরের ছেলে। দাদার লাশ দেখে ও জিনে মেরে ফেলেছে শুনে খুব ভয় পেয়েছিল। সেই থেকে জিনকে রসু ভীষণ ভয় পায়। এখন আবার লেঠেলদের মুখে নাদের আলির বাস্তুতে জিন আছে শুনে সেই ভয় আরো বেড়ে গেল। মুশতাক বিশ্বাসের কথা শুনে ভয়ার্তস্বরে বলল, না মাতব্বর সাহেব, জিনকে আমি খুব ভয় করি।
মুশতাক বিশ্বাস দমবার পাত্র নন। রসুকে বিদায় করে চিন্তা করলেন, প্রথমে কোনো একজন বড় খোনকার এনে নাদের আলির বাস্তুর জিনকে তাড়াতে হবে। তারপর নাদের আলির ব্যবস্থা করবেন। তার আগে হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে আতিকার বিয়ের কাজটা মিটিয়ে ফেলতে হবে।
এশার নামায পড়ে ছেলেকে ডেকে বললেন, পরশু শুক্রবার তোমার দাদাজীর মৃত্যুবার্ষিকী। হাবিব ডাক্তার ঢাকা থেকে ফিরেছে। কাল তুমি নিজে গিয়ে তাকে আমার কথা বলে আসতে বলবে। তোমার দাদাজীর মৃত্যুবার্ষিকীর কথা জানাবে না।
পারভেজ বলল, ঠিক আছে আব্বা, তাই হবে।
০৬. হাবিব ডাক্তার ঢাকা থেকে
হাবিব ডাক্তার ঢাকা থেকে দু’দিন পরে ফেরার কথা বলে গেলেও ব্যাংক থেকে টাকা তোলার ব্যাপারে এক সপ্তাহ দেরি হল। বিকেলে পৌঁছে সাগীর ডাক্তারের মুখে সূতাপাড়ায় রুগীর মুমূর্ষ অবস্থার কথা শুনে দেখতে গিয়েছিল। সেই সাথে টাকাটা নাদের আলিকে দেয়ার জন্য খাঁপাড়ায় গিয়েছিল।
আজ পারভেজকে দেখে ভাবল, সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে মুশতাক বিশ্বাস ছেলেকে পাঠান নি তো? সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, কারো অসুখ বিসুখ করেছে না কী?
পারভেজ বলল, না। আব্বা আপনাকে কাল সকালের দিকে যেতে বলেছেন।
কারো যখন কিছু হয় নি তখন বিকেলে গেলে হয় না? সকালের দিকে ঠাকুরপুরে দু’তিনটে রুগী দেখতে যাব।
ঠাকুরপুরে বিকেলে যাবেন। আব্বা আপনাকে অতি অবশ্য সকালে যেতে বলেছেন।
ঠিক আছে, সকালের দিকেই যাব।
তা হলে আসি বলে পারভেজ বিদায় নিয়ে চলে এল।
আজ শুক্রবার। হেলথ কমপ্লেক্স বন্ধ। তাই হাবিব ডাক্তার সকাল আটটার দিকে কুতুবপুর রওয়ানা দিল। মুশতাক বিশ্বাসের বাড়ির কাছে এসে দেখল, অনেক লোকজনের সমাগম। বৈঠকখানার উঠোনের একপাশে বড় ডেগচিতে বাবুর্চিরা রান্নাবান্না করছে। আর একদিকে তিনটে গরু ও চারটে খাসি জবাই করা হয়েছে। লোকজন সেগুলোর গোস্ত কাটাকাটি করছে। অবাক হয়ে ভাবল, আজ আতিকার বিয়ে নয় তো? সেই জন্যই কি মুশতাক বিশ্বাস আজ সকালে আসার জন্য পারভেজকে পাঠিয়েছিলেন? আবার ভাবল, তা কি করে সম্ভব? আতিকা এত সহজে রাজি হওয়ার মতো মেয়ে তো নয়? না তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে?