হাবিব ডাক্তার এসে পায়ের অবস্থা পরীক্ষা করে বলল, এ যে দেখছি কেউ শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে পায়ের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে। আল্লাহ না করুক, হাড় জোড়া না লাগলে হাঁটুর নিচ থেকে কেটে বাদ দিতে হবে।
গিয়াস হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, অমন কথা বলবেন না ডাক্তার সাহেব। পা কেটে বাদ দিলে ছেলেমেয়েদের মুখের আহার জোটাব কি করে? আপনি খুব আল্লাহওয়ালা ডাক্তার। পা যাতে কেটে বাদ দিতে না হয় সেই ব্যবস্থা করুন। আমার বিশ্বাস আপনি চেষ্টা করলে আমার পা ভালো করে দিতে পারবেন।
আমি ভালো করার কে? সবকিছু করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। ডাক্তারী বিদ্যামতো চেষ্টা করব। বাকি তিনি যা করার করবেন। তবে কয়েকটা কথা বলব, সেগুলো মেনে চলে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করুন। তিনি গফুর রহিম, ইচ্ছা করলে আপনার পা কেটে বাদ না দিয়েও ভালো করে দিতে পারেন।
আপনি বলুন ডাক্তার সাহেব, আপনার সব কথা মেনে চলব।
হাবিব ডাক্তার এতক্ষণ পায়ে প্লাস্টার করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
এবার কাজ শুরু করে বললেন, তার আগে যা জিজ্ঞেস করব, সত্য উত্তর দেবেন। পাটা এভাবে ভাঙল কী করে?
সত্য মিথ্যা কোনোটাই বলতে না পেরে গিয়াস চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হাবিব ডাক্তার বলল, কী হল, চুপ করে আছেন কেন?
একজন লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেছিল।
কে বাড়ি মেরেছে? আর কেনই বা মেরেছে?
এই কথারও উত্তর দিতে না পেরে গিয়াস চুপ করে রইল।
হাবিব ডাক্তার আর কোনো প্রশ্ন না করে প্লাস্টারের কাজ শেষ করল। তারপর বলল, আপনি বোধ হয় জানেন, সত্য কোনোদিন গোপন থাকে না। দু’দিন আগে পরে সবাই জেনে যাবেই। এখন বলতে দ্বিধা করছেন কেন? কি এমন ঘটনা হয়েছিল, লোকটা লাঠি মেরে আপনার পা ভেঙ্গে দিল?
গিয়াস লজ্জায় ঘটনাটা বলতে না পেরে মাথা নিচু করে বসে রইল।
হাবিব ডাক্তার বলল, ঘটনাটা বলতে যখন লজ্জা করছে তখন আপনার ঈমান ও বিবেক দু’টোই আছে। হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলেছেন, “লজ্জা ঈমানের অর্ধেক। যার লজ্জা নেই, তার ঈমানও নেই।” আর যার ঈমান আছে তাকে মুসলমান বলে। “এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভাই।” এটাও কুরআন হাদিসের কথা। এক ভাই আর এক ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারে কী? যদি কেউ করে, তবে একদিন না একদিন তার দ্বারা অথবা অন্যের দ্বারা তারও ক্ষতি হবে। শুনুন, আমি এখানে দু’বছরের বেশি হয়ে গেল এসেছি, ডাক্তার হিসাবে আশপাশের গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই রুগী দেখতে গিয়ে সবার সঙ্গে কম বেশি পরিচয় হয়েছে। কে কেমন তাও কিছু কিছু বুঝেছি। আপনি শক্তি সামর্থবান লোক হয়ে একজনের পিছন পিছন ঘঘারেন, সত্যি মিথ্যা বলে তোষামোদ করেন ও তার কথামতো বিবেক বিসর্জন দিয়ে অন্যের ক্ষতি করেন। এসব করা কী উচিত? আল্লাহ যতটুকু জমি-জায়গা দিয়েছেন, চাষবাস করুন। তাতে সংসার না চললে অন্য কোনো সৎ পথে রুজী রোজগার করার চেষ্টা করুন। তাতে করে ইহকাল ও পরকালের জীবনে সুখ-শান্তি পাবেন। এই যে আজ এরকম বিপদে পড়লেন, কেন পড়লেন চিন্তা করেছেন? নিশ্চয় কারো ক্ষতি করতে গিয়েছিলেন? ছেলেমেয়েরা সাধারণত মা-বাবাকে অনুসরণ করে। আপনার ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, তাদের কাছে সৎ বাবা হওয়ার চেষ্টা করুন। আপনাকে অসৎ দেখলে তারাও বড় হয়ে অসৎ হবে। যাক, আজ আর বেশি কিছু বলব না। শুধু এতটুকু বলব, যারা অন্যের ক্ষতি করে, পারতপক্ষে তারা নিজেরই ক্ষতি করে। আর যারা অন্যের ভালো করার চেষ্টা করে, আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেন। আর সেই সাহায্য কোনো একজনের দ্বারা করান। সৎভাবে সংসার চালাতে গেলে যদি অভাব অনটনে পড়েন, তা হলে ব্যবসা করুন। টাকা পয়সা লাগলে আমি আপনাকে কর্জে হাসানা দেব। যখন সুযোগ সুবিধে হবে তখন শোধ করে দেবেন। তবে এসব কথা কাউকে বলবেন না। তারপর প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে বলল, ওষুধ কেনার টাকা না থাকলে আপনার ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। এবার আসি বলে সালাম বিনিময় করে হাবিব ডাক্তার চলে গেল।
গিয়াস আগে হাবিব ডাক্তারকে যতটা না আল্লাহওয়ালা বলে জানত, এখন তার কথা শুনে আরো বেশি আল্লাহওয়ালা বলে মনে হল। ভাবল, আজকালের যুগের এরকম মানুষও তা হলে আছে? সিদ্ধান্ত নিল, সে আর মুশতাক বিশ্বাসের চামচাগিরী করবে না। পা ভালো হয়ে গেলে গতর খাটিয়ে সংসার চালাবে এবং হাবিব ডাক্তারের কাছ থেকে টাকা হাওলাত নিয়ে বাজারে যে কোনো ব্যবসা করবে।
এমন সময় তার ছেলে লতিফ এসে বলল, বদরুল চাচা এসেছে।
গিয়াস বলল, এখানে আসতে বল।
বদরুল এসে তার একটা পা প্লাস্টার করা দেখে অবাক হয়ে বলল, কাল তোমাকে ভালো দেখলাম, কি এমন ঘটনা ঘটল যে, পা প্লাস্টার করতে হল? আজ তুমি যাওনি বলে মাতব্বর সাহেব তোমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠালেন।
ঘটনা বলা যাবে না। তুমি মাতব্বর সাহেবকে বলবে, তার কাজ করতে গিয়ে আমার এই অবস্থা হয়েছে। তাই যেতে পারি নি।
বদরুল ফিরে গিয়ে গিয়াসের কথাগুলো মুশতাক বিশ্বাসকে বলল।
মুশতাক বিশ্বাসের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বদরুলকে বলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার কাজে যাও।
বদরুল চলে যাওয়ার পর চিন্তা করতে লাগলেন, গিয়াসের পা ভেঙ্গেছে ভাঙ্গুক, কিছুদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে; কিন্তু নাদের আলির কি করল জানাল না কেন?