সে কথা নাদের আলি একদিন আতিকাকে বলে। আতিকা তখন তরুণী। সেদিন ঘরে এসে মাকে জিজ্ঞেস করে খায়েদের সঙ্গে নাকি আমাদের অনেকদিনের শত্রুতা?
শাফিয়া বানু বললেন, হ্যাঁ। খবরদার, খায়েদের কোনো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করবি না।
খাঁয়েদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা কেন আম্মা?
তুই এখন ছেলে মানুষ, ওসব কথা জানার দরকার নেই। যখন আরো বড় হবি তখন নিজেই জানতে পারবি।
মায়ের কথায় আতিকা খুশি হতে পারল না। তাই একদিন দাদিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিল।
জানার পর ভেবেছিল, নাদের আলির সঙ্গে আর মেলামেশা করবে না। কিন্তু ততদিনে তাকে ভালবেসে ফেলেছে। তাই খুব বেশি দিন তার সঙ্গে দেখা না করে থাকতে পারে নি।
নাদের আলিরও একই অবস্থা। তবু আতিকাকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয় নি।
তারপর তারা যে সম্পর্ক রেখেছে ও গোপনে দেখা সাক্ষাৎ করে তা হানিফা খাতুন জানতেন না। কয়েক মাস আগে যেদিন হাবিব ডাক্তার নাদের আলির সঙ্গে এসে পরিচয় দিয়ে বলল, সে তাদেরই বংশের ছেলে এবং যেমন করে হোক নাদের আলির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আতিকাকে বৌ করে করে আনবে সেদিন জানতে পারেন। তারপর হাবিব ডাক্তার যে নাদের আলিকে জমি-জায়গা কিনে দিয়েছে ও পাকা বাড়ি করে দিচ্ছে তাও জানেন। তাই আজ আতিকা যখন বিপদের কথা বলে সাবধান করে দিয়ে চলে গেল এবং নাদের আলি পশ্চিমপাড়ায় আজরাফ মাস্টারের বাড়িতে রাত কাটাবার কথা বলল তখন জিজ্ঞেস করলেন, আজরাফ মাস্টার হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও তোর ও আতিকার সম্পর্কের কথা জানে?
নাদের আলি বলল, হ্যাঁ জানে।
তা হলে এক কাজ কর, খেয়ে তুই চলে যা, আমি এখানে থাকি।
এ তুমি কি বলছ ফুফু? তোমাকে একা রেখে গেলে ওরা আমাকে না পেয়ে তোমার উপর অত্যাচার করবে।
এমন সময় হাবিব ডাক্তারের গলা শুনতে পেল।
নাদের আলি ঘরে আছ না কি?
তার গলা পেয়ে নাদের আলির ভয় কেটে গেল। বলল, আসুন ডাক্তার ভাই। হাবিব ডাক্তার পরিচয় দেয়ার পর নাদের আলি তাকে ডাক্তার ভাই বলে ডাকে।
হাবিব ডাক্তার কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, তোমাদের সব কথা শুনেছি। কাউকেই কোথাও যেতে হবে না। মাঝপাড়ায় রুগী দেখতে এসেছিলাম, পথে আতিকার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার কাছে সবকিছু শুনে এখানে এলাম। তারপর হানিফা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল, খালাআম্মা, কোনো চিন্তা করবেন না। আজ আমিও আপনাদের সঙ্গে থাকব।
হানিফা খাতুন বললেন, কিন্তু ওরা যদি দলে ভারি হয়।
হাবিব ডাক্তার বলল, আল্লাহ ভরসা। তারপর নাদের আলিকে বলল, লাঠি দু’গাছা যত্ন করে রেখেছ তো?
নাদের আলি বলল, হ্যাঁ রেখেছি।
হাবিব ডাক্তার বলল, ওরা রাত বারটার পরে আসবে তো আগে আসবে না। আমি পশ্চিমপাড়ায় যাচ্ছি, আজরাফ স্যারের সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। ওখান থেকে এসে খাওয়া-দাওয়া করব। তারপর কেউ কিছু বলার আগে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
রাত একটার দিকে গিয়াস ছয় সাতজন লোক নিয়ে নাদের আলিকে মেরে তার হাত পা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য খপাড়ায় এল। তারপর তার ঘরের কাছে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে গিয়াস আবছা দেখতে পেল, উঠোনের মাঝখানে সাদা পোশাকে লম্বা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে পাঁচ ব্যাটারী টর্চ ছিল, টর্চ জ্বেলে যা দেখল, তাতে সবাইয়ের আত্মারাম খাচা। মাথায় সাদা পাগড়ী, চোখ ছাড়া সাদা কাপড়ে মুখ পেচান, গায়ে লম্বা সাদা ঝুল পিরান, হাতে একটা বড় লাঠি। চোখ দুটো যেন আগুনের ভাটার মতো জ্বলছে। গিয়াসের সঙ্গীরা ওরে বাবারে জিন বলে ছুট দিল। গিয়াস সবার পিছনে পড়ে গেল।
হাবিব ডাক্তার নাদের আলিকে কিছু পরামর্শ দিয়ে এই পোশাকে লাঠি হাতে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। আর নাদের আলি বাস্তুর কিনারের বড় আমগাছের আড়ালে লাঠি হাতে লুকিয়েছিল। হাবিব ডাক্তারের পরামর্শ মতো পলায়নপর গিয়াসের ডান পায়ে প্রচণ্ড জোরে লাঠি দিয়ে আঘাত করল।
গিয়াস বাবারে মেরে ফেলল রে বলে আর্তচিৎকার করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। লাঠির আঘাতে তার পা ভেঙ্গে গেলেও জান বাঁচাবার জন্য ভাঙ্গা পা নিয়ে একপায়ে নেংচি কাটতে কাটতে ছুটল। কিছুটা এসে যখন চলতে পারল না তখন সঙ্গীদের ডাক দিয়ে বলল, তোরা আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যা, আমার একটা পা ভেঙ্গে গেছে।
সঙ্গীরা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে তাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে লাগল।
নাদের আলি যে গিয়াসের পায়ে লাঠির বাড়ী দিয়েছে, গিয়াস তা জানতে পারে নি। তাই বলল, জিনটা উঠোন থেকে লাঠি ফিকে মেরেছে। যে রকম যন্ত্রণা হচ্ছে, তাতে করে মনে হয় পাটা ভেঙ্গে গেছে।
সঙ্গীদের একজন বলল, নানার কাছে জিনের গল্প শুনেছিলাম, আজ চোখে দেখলাম। বারেক তুমি টর্চ জ্বেলেছিলে, নচেৎ জিনটা সবাই এর পা ভেঙ্গে দিত।
গিয়াস যাদেরকে নিয়ে এসেছিল, তারা সবাই লেঠেল। তাদের একজন শুধু তার চাচাত ভাই। আর বাকি সবাই কামড়ীপাড়ার লোক। তারা গিয়াসকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। গিয়াস ও ঐ লোকটির বাড়ি মাঝপাড়ায়।
পরের দিন অনেক বেলা পর্যন্ত গিয়াস আসছে না দেখে মুশতাক বিশ্বাস বদরুল নামে একজন লোককে তাকে ডেকে নিয়ে আসতে মাঝপাড়ায় পাঠালেন।
গিয়াস পায়ের ব্যথায় সারারাত ছটফট করেছে। সকালে ছেলে লতিফকে কার্পাসডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্সে হাবিব ডাক্তারকে আনতে পাঠিয়েছিল।