আরে, কিছু না বলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছ যে? মনে হচ্ছে আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়েছ?
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, আলাউদ্দিনের চেরাগই পেয়েছি।
দূর, ওটা তো আগের যুগের কল্পকাহিনী। আসল ব্যাপারটা বল তো।
আসল ব্যাপারটা বললে আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো কল্পকাহিনী মনে হবে।
তা হোক, তবু বল।
বলা যাবে না। তবে এতটুকু বলতে পারি। “আল্লাহ যারে দেয়, ছাপ্পর ফাইড়া দেয়।”
ওটা তো একটা কথার কথা, আসল ব্যাপারটা বলা যাবে না কেন?
তাও বলা যাবে না। কারণ জানাজানি হয়ে গেলে আমি বিপদে পড়ে যাব। তবে যখন বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কেটে যাবে তখন বলব।
আতিকা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে, তা হলে থাক, বলতে হবে না। পরেই না হয় শুনব।
এমন সময় নাদের আলির দৃষ্টি রাস্তার দিকে পড়তে মুশতাক বিশ্বাস ও গিয়াসকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে বলল, এই, তোমার আব্বা ও গিয়াস চাচা আমাদেরকে দেখছেন।
কথাটা শুনে আতিকাও চমকে উঠে যখন রাস্তার দিকে তাকাল তখন মুশতাক বিশ্বাস ও গিয়াস মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন। তাদেরকে চলে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক দেখেছ, আব্বা ও গিয়াস চাচা আমাদেরকে দেখেছে?
নাদের আলির মনে তখন ভয়ের ঝড় বইছে। কোনো রকমে বলল, হ্যাঁ, ওনারা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।
আতিকা বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমার মনে হয়, এতদূর থেকে আমাদেরকে চিনতে পারে নি। চিনতে পারলে আব্বা নিশ্চয় গিয়াস চাচাকে দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে পাঠাত।
কি জানি, তোমার কথা হয়তো ঠিক। এবার তুমি যাও। তোমার আব্বা ঘরে গিয়ে তোমার খোঁজ করবেন। আর শোন, আমার মনে হয়, এখানে দেখা করা ঠিক হবে না। দু’একমাস যাক, তারপর না হয় দেখা যাবে।
আতিকা বলল, ঠিক আছে, আমি হালিমের হাতে খবর দিলে আসবে। তারপর তারা যে যার পথে চলে গেল।
মুশতাক বিশ্বাস ঘরে আসার আগে অন্য রাস্তা দিয়ে আতিকা ঘরে এসে নামায পড়ল। তারপর আব্বা ঘরে এসে মায়ের সঙ্গে যা কিছু কথাবার্তা বলেছে আড়াল থেকে তাদের সব কথা শুনে জানতে পারল, আব্বা ও গিয়াস চাচা তাদেরকে ঠিকই দেখেছে। আরো জানতে পারল, আব্বা-আম্মা হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চায়। আব্বা তাদেরকে দেখেছে জেনে ভয় পেলেও হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে তার বিয়ের কথা জেনে ভয় পেল না। আম্মা চা-নাস্তা আনতে গেলে নিজের রুমে এসে ভাবল, যাক বাচা গেল। যখন এসব কথা জানাতে আম্মাকে নিষেধ করল তখন সেও নিশ্চয় আপাতত আমাকে কিছু বলবে না। সঙ্গে সঙ্গে আজ রাতেই নাদের আলির পাখা ভেঙ্গে দেয়ার কথা মনে পড়তে চমকে উঠল। তাকে সাবধান করার জন্য তখনই রওয়ানা দিল। এখন খাঁপাড়ায় যাওয়া তার যে উচিত নয়, সে কথা একবারও মনে পড়ল না। ততক্ষণে রাতের অন্ধকার নামলেও রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে। মাথার কাপড়টা মুখের উপর কিছুটা ঝুলিয়ে লোকজনকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। দু’একজন জিজ্ঞেস করল, কে তুমি, কোথায় যাবে? আতিকা না শোনার ভান করে তাদেরকে পাশ কেটে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।
যারা বাড়ির কাজ করছে তাদেরকে বিদায় করে নাদের আলি ফুফুর সঙ্গে কথা বলছিল। এমন সময় আতিকাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। বলল, কী ব্যাপার? এই রাতের বেলায় আবার এলে কেন? কোনো বিপদ হয় নি তো?
আতিকা দ্রুত হেঁটে এসে হাঁপিয়ে পড়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমার কোনো বিপদ হয় নি। তবে আজ রাতে তোমার বিপদ হবে। গিয়াস চাচা তার লোকজন নিয়ে তোমাকে মারধর করতে আসবে শুনে তোমাকে সাবধান করতে এলাম। এখন চলি, জানাজানি হয়ে গেলে আব্বা আম্মা আস্ত রাখবে না। তুমি আজ রাতে ঘরে থেক না বলে যেমন দ্রুত এসেছিল, তেমনি দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আতিকার কথা শুনে নাদের আলি ভয় পেলেও দ্রুত তার পিছন পিছন আসতে আসতে বলল, একটু দাঁড়াও, আমি তোমাকে কিছু দূর এগিয়ে দিই।
আতিকা না দাঁড়িয়ে যেতে যেতে বলল, এগিয়ে দিতে হবে না। তোমাকে আমার সঙ্গে কেউ দেখে ফেললে তখন দু’জনেরই বিপদ হবে। যা বললাম তাই করবে।
নাদের আলি থমকে দাঁড়িয়ে অন্ধকার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ফিরে এসে ফুফুকে বলল, আমাকে ভাত দিয়ে তুমিও খেয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে পশ্চিমপাড়ায় আজরাফ স্যারের বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাব।
নাদের আলির ফুফু হানিফা খাতুনের তিনবার বিয়ে হয়। প্রথম স্বামী পাঁচ বছর তাকে নিয়ে সংসার করে। এই ক’বছরে পেটে বাচ্চা আসে নি বলে বাজা ভেবে তালাক দিয়ে সেই স্বামী আবার বিয়ে করে। দ্বিতীয় স্বামীও তাকে নিয়ে পাঁচ-ছ’বছর সংসার করে এবং একই কারণে তালাক দিয়ে আবার বিয়ে করে। আবার তৃতীয় স্বামী বিয়ের দু’বছরের মাথায় মারা যায়। তারপর বাপ-ভাই বিয়ে দিতে চাইলেও তিনি রাজি হন নি। সেই থেকে বাপ-ভাইদের সংসারে থাকেন। মা-বাপ অনেক আগে মারা গেছেন। ভাই-ভাবিও বন্যার বছরে মারা গেছেন। মা-বাবাকে হারিয়ে ফুফুই এখন নাদের আলির সব। তা ছাড়া হানিফা খাতুন যে বছর বিধবা হয়ে ফিরে আসেন। তখন নাদের আলি ছোট ছিল। তিনিই একরকম তাকে মানুষ করেছেন। স্কুলে পড়ার সময় যখন আতিকা তাদের বাড়িতে আসত তখন তার পরিচয় জানবার পর একদিন তিনি নাদের আলিকে মুশতাক বিশ্বাসের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের শত্রুতা ও শত্রুতার কারণ জানিয়ে বলেছিলেন, আতিকার সঙ্গে তুই মেলামেশা করবি না। আর তাকেও বলে দিবি, সে যেন এ বাড়িতে না আসে।