ঠিক আছে, আপাতত পাখা কেটে দেয়ার ব্যবস্থা কর।
জি, সেটাই ভালো হবে।
এবার তুমি যাও বলে মুশতাক বিশ্বাস মসজিদের দিকে চলে গেলেন। নামায পড়ে গম্ভীর মুখে বাড়িতে ঢুকলেন।
শাফিয়া বানু জানেন, স্বামী মাদ্রাসার মিটিং-এ বইরাপাড়ায় গেছে। তাকে খুব গম্ভীর মুখে ফিরতে দেখে ভাবলেন, মিটিং এ ফলাফল ওনার মনের মতো হয় নি। কাছে এসে বললেন, শরীর খারাপ লাগছে?
মুশতাক বিশ্বাস স্ত্রীর কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, আতিকা কোথায়? কেন?
এই তো নামায পড়ল।
সন্ধ্যের আগে কোথায় ছিল?
তা বলব কি করে। আসরের নামায পড়ে হয়তো চাচাদের কারো বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল।
সেয়ানা মেয়ে কোথায় যায়, কি করে, খোঁজ রাখবে না?
ওকি ছোট যে, সব সময় ওর দিকে লক্ষ্য রাখব। মা হিসাবে যতদিন লক্ষ্য রাখার ততদিন রেখে মানুষ করেছি। এখন বড় হয়েছে, লেখাপড়া করেছে, এবার বাবা হিসাবে তোমার কর্তব্য, ভালো ঘরে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেয়া। ওর জুড়ি সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা বাপের বাড়ি এলে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে। ওর মনের দিকটা চিন্তা করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু বাপ হয়ে সেই উচিত কাজটা তুমি করছ না কেন?
স্ত্রীর কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাসের রাগ পড়ে গেল। বললেন, হ্যাঁ তুমি ঠিক কথা বলেছ। তবে আমি যে পাত্রের খোঁজ করি নি তা নয়। উপযুক্ত পাত্র পাচ্ছি না বলে দেরি করছি।
কেন? সেদিন তো হাবিব ডাক্তারের কথা বললে? তার সঙ্গে আলাপ কর নি?
পারভেজের হাতে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, সে নাকি ঢাকা গেছে, দু-একদিনের মধ্যে ফিরবে। এখন যা বলছি শোন, মিটিং থেকে ফেরার সময় মাঝপাড়ায় রশিদ শেখের পুকুরপাড়ে নাদের আলির সঙ্গে আতিকাকে আলাপ করতে দেখলাম, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো ঠেকছে না।
শাফিয়া বানু চমকে উঠে সামলে নিলেন, বললেন, তুমি হয়তো ভুল দেখেছ। আতিকা নাদের আলির সঙ্গে আলাপ করতে যাবে কেন?
মুশতাক বিশ্বাস গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি একা দেখলে হয়তো তাই মনে হত; কিন্তু গিয়াসও সঙ্গে ছিল। সে তো আর ভুল দেখে নি? ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, ওদের সম্পর্ক অনেক দিনের। শালা ফকিন্নীর বাচ্চার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি, খ বংশের কুত্তার বাচ্চা আমার মেয়ের সঙ্গে কিনা…কথাটা রাগে শেষ করতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, পিঁপড়ের পাখা গজায় মরার জন্য। ঐ কুত্তার বাচ্চাটারও পাখা গজিয়েছে। আজ রাতেই বাছাধন কতধানে কত চাল বুঝতে পারবে।
আজ রাতেই স্বামী যে লোক দিয়ে নাদের আলির ক্ষতি করবে, তা শাফিয়া বানু বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হলেন। বললেন, নাদের আলি কতটা দোষী সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে কিছু করা ভালো। নচেৎ গ্রামে সালিশী বসলে তোমার সম্মান থাকবে? আমি চাই না, হঠাৎ করে কিছু করে তুমি সালিশের সম্মুখীন হও।
মুশতাক বিশ্বাস হো হো করে হেসে উঠে বললেন, শুধু এই গ্রামের নয়, আশপাশের পাঁচ-দশটা গ্রামের এমন কারো বুকের পাটা নেই, আমার নামে সালিশ ডাকবে।
এত বছর এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছি, সে কথা আর জানি না?
তা হলে কোনো দুশ্চিন্তা করো না। শুধু দেখে যাও কি করি। আর শোন, এ ব্যাপারে আতিকাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। তবে কখন কোথায় যায় লক্ষ্য রাখবে।
শাফিয়া বানু বললেন, ঠিক আছে, তুমি বস, চা-নাস্তা নিয়ে আসি।
হাবিব ডাক্তার নিষেধ করার পর আতিকা ও নাদের আলি পাঁচ-ছ’মাস কেউ কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে নি। কিন্তু আজ আতিকা থাকতে না পেরে গোপনে নাদের আলির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল। মাঝপাড়ায় রহিম শেখের পুকুর পাড়ের কাছে তার সঙ্গে দেখা হয়। তারপর তাকে নিয়ে পুকুরের ওপারের পাড়ে গিয়ে বলল, তোমাকে এতদিন না দেখে খুব খারাপ লাগছিল, তাই তোমাদের ঘরে যাচ্ছিলাম। এবার থেকে প্রতি সোমবার এখানে এই সময়ে থাকবে, আমি আসব।
নাদের আলি ভয় পেয়ে বলল, কিন্তু একদিন না একদিন কেউ দেখে ফেলবে। তখন কী হবে ভেবেছ?
আমি এভাবে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে আসব, কেউ চিনতে পারবে না।
তবু নাদের আলির ভয় কাটল না। বলল, হাবিব ডাক্তার আমাদেরকে দেখা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি জানতে পারলে হয়তো আমাদের জন্য কিছুই করবেন না।
আজ এক বছরের বেশি হয়ে গেল, কই, কিছু করতে পেরেছেন?
উনি তলে তলে অনেক কিছু করছেন।
কি করেছেন শুনি?
একদিন আমি জিজ্ঞেস করতে শুধু বললেন, “আতিকাকে এনে রাখবে কোথায়? খাওয়াবে কি? সে বড় লোকের আদরের মেয়ে। এই বেড়ার ঘরে ডাল ভাত খেয়ে থাকবে নাকি? আগে বাড়িঘর পাকা কর, জমি-জায়গা কিনে নিজে চাষবাস করে উন্নতি কর। তারপর আতিকাকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা আমি করব।”
হাবিব ডাক্তারের কথামতো এসব করতে করতে তুমি যেমন বুড়ো হয়ে যাবে, আমিও তেমনি বুড়ী হয়ে যাব। তা ছাড়া মা-বাবা অতদিন আমাকে আইবুড়ী করে ঘরে রেখে দেবে বুঝি?
আমি তাকে সে কথা বলেছিলাম। বললেন, “ইনশাআল্লাহ এক দেড় বছরের মধ্যে তুমি সবকিছু করতে পারবে।”
তা এই এক বছরের মধ্যে তুমি কিছু এগোতে পেরেছ?
কিছু জমি-জায়গা কিনে চাষবাস করছি, দু’কামরা পাকা বাড়ির কাজও প্রায় শেষ করে এনেছি।
আতিকা অবাক হয়ে বলল, তাই না কী? তা তুমি এত টাকা-পয়সা পেলে কোথায়?
নাদের আলি কিছু না বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।