স্ত্রীর শেষের কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাস খুশি হলেন। বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ। ডাক্তারকে আসার জন্য পারভেজকে বলেছি, এলে আলাপ করে তার মতামত জানা যাবে।
শোন, ডাক্তার যদি আতিকাকে গ্রামের মেয়ে ভেবে বিয়ে করতে রাজি না হয়, তা হলে জমি-জায়গা ও টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে হলেও রাজি করাবে।
মুশতাক বিশ্বাস মৃদু হেসে বললেন, পারভেজের মা, সেকথা তোমার না বললেও চলতো। এমন গুটি চালব, ডাক্তার বেটা রাজি না হয়ে পারবে না।
শাফিয়া বানুও মৃদু হেসে বললেন, এত বছর তোমাকে নিয়ে সংসার করছি, আজ পর্যন্ত তোমাকে কোনো কাজে হারতে দেখি নি, এ কাজেও তুমি হারবে না, তা আমিও জানি। তবু একটু স্মরণ করিয়ে দিলাম আর কি।
এই জন্যইতো তোমাকে এত ভালবাসি বলে মুশতাক বিশ্বাস এদিক ওদিক তাকিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন।
শাফিয়া বানুও এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, একি করছ? ছাড় ছাড়। এত বয়স হল, তবু রস কমল না।
মুশতাক বিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললেন, বয়স হলে মেয়েদের রস কমে যায় কেন বলতে পার?
শাফিয়া বানু কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, বলতে পারব না। তুমি তোমার রস নিয়ে থাক বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।
কয়েকদিন পর এক বিকেলে বইরাপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায় মিটিং ছিল। চামচা গিয়াসকে নিয়ে যাওয়ার সময় মুশতাক বিশ্বাস জিজ্ঞেস করলেন, হাবিব ডাক্তারের পরিচয় জানতে পারলে?
জি না মাতব্বর সাহেব। তবে চেষ্টায় আছি।
তোমাকে আর চেষ্টায় থাকতে হবে না। আর হাশেম আলির বাড়ির দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে না। আমি নিজেই জেনেছি, হাবিব ডাক্তারের মতো ভালো ছেলে আর হয় না।
গিয়াস খুব অবাক হয়ে ভাবল, মাতব্বর সাহেব কয়েকদিন আগে পর্যন্ত হাবিব ডাক্তারের উপর ক্ষ্যাপা ছিলেন। তার সম্পর্কে কার কাছে কি এমন শুনলেন যে, এখন আবার তার সুনাম করছেন! কিছু বুঝে উঠতে না পেরে চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর মুশতাক বিশ্বাস বললেন, তোমার কাছে ব্যাপারটা ঘোলাটে মনে হচ্ছে, তাই না?
গিয়াস বলল, আপনার মতো বুদ্ধিমান মানুষ শুধু এই গ্রামে না, আশপাশের কয়েকটা গ্রামেও নেই। তাই তো সব গ্রামের সালিশীতে আপনার ডাক পড়ে।
আমি মূখ লোক, একটু খোলাসা করে না বললে বুঝব কী করে?
মুশতাক বিশ্বাস নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হয়ে বললেন, বলছি শোন, আমি পাঁচ-ছ’দিন আগে পশ্চিমপাড়ায় আজরাফ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়াছিলাম। আজরাফ মাস্টার কেমন লোক তাতো জান। তার কাছেই হাবিব ডাক্তারের সবকিছু জেনেছি।
প্রায় সাত আট মাস আগে গিয়াসের দশ বছরের মেয়ে যয়নাবের ডাইরিয়া হয়ে মরামরা অবস্থা হয়েছিল। ঘরে কান্নাকাটিও পড়ে গিয়েছিল। সেই সময় হাবিব ডাক্তারকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে একজন ডেকে নিয়ে আসে। তার চিকিৎসায় যয়নাব বেঁচে যায়। গ্রামের সবার মতো গিয়াসও হাবিব ডাক্তারকে
পীরের মতো ভক্তিশ্রদ্ধা করে। মাতব্বর সাহেবকে শুধু খুশি রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে একটু-আধটু মিথ্যে বলে। এখন মাতব্বরের কথা শুনে অবাক হলেও খুব। খুশি হল। তা প্রকাশ না করে চুপ করে রইল।
কী হল, ভালো মন্দ কিছু বলছ না যে?
আপনি সবকিছু জেনে যা বললেন, তা ভালো ছাড়া কখনও মন্দ হতে পারে। তবে হাশেম আলির মেয়ের ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখলে ভালো হত।
মুশতাক বিশ্বাস হেসে উঠে বললেন, তুমি অবশ্য ঠিক কথা বলেছ। তবে আমি কথায় কথায় ব্যাপারটা আজরাফ মাস্টারের কাছ থেকে জেনেছি। আসল ঘটনা হল, হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে চিকিৎসা করছে। তাই মাঝে মাঝে যায়। সে সময় তার মেয়ের সঙ্গে হয়তো কিছুক্ষণ আলাপ করে। তুমিও তো জান, হাশেম আলির মেয়ে খুব পর্দানশীল। আর হাবিব ডাক্তার যে খুব ধার্মিক তাও তো জান?
গিয়াস হাসি মুখে বলল, আপনি যখন বলছেন, তখন আর কোনো চিন্তা নেই।
তা হলে বল, হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে আতিকার বিয়ে দিলে কেমন হবে?
খুব ভালো হবে। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাড়াতাড়ি সেদিন দেখান।
মুশতাক বিশ্বাস গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, গিয়াস।
মাতব্বর সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে গিয়াস ঘাবড়ে গেল। ভাবল, কিছু ভুল বলে ফেললাম না তো? মিনমিনে গলায় বলল, জি মাতব্বর সাহেব বলুন।
কথাটা যেন আর কেউ না জানে।
গিয়াস স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, জি-জি, তাতো বটেই।
মিটিং সেরে ফেরার পথে খাপাড়া ছেড়ে মাঝপাড়ায় রশিদ শেখের পুকুরপাড়ের কাছে এসে মুশতাক বিশ্বাস পুকুরে ওপাড়ের একটা বড় নীম গাছের আড়ালে একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। যদিও সন্ধ্যায় আবছা অন্ধকার নেমেছে, তবু তাদেরকে চিনতে পারলেন। আতিকা নাদের আলির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে।
মুশতাক বিশ্বাসের পিছনে গিয়াস ছিল। মাতব্বরকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সেও দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও বোঝার ভান করে বলল, দাঁড়ালেন কেন মাতব্বর সাহেব। চলুন মাগরিবের নামাযের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মুশতাক বিশ্বাস দৃষ্টি সরিয়ে কিছুটা পথ আসার পর বললেন, কিছু দেখেছ?
জি, নাদের আলির পাখা গজিয়েছে।
পাখা কেটে দাও।
জি, তাই দেব।
শুধু পাখা নয়, আজ রাতেই ওকে একেবারে শেষ করে দেবে।
সেটা কি ঠিক হবে মাতব্বর সাহেব? তার চেয়ে পাখাটা কেটে দিলেই ভালো হবে। একেবারে শেষ করে দিলে, পুলিশের ঝামেলা হবে। ওরা গন্ধ শুকে শুকে একদিন না একদিন খুনীকে আবিষ্কার করবে। তা ছাড়া নাদের আলি হাবিব ডাক্তারের পেয়ারের। সেও কম কিছু করবে না।