মুশতাক বিশ্বাস ছেলেকে নিজের মতো করে মানুষ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সফল হন নি। এক ছেলে বলে তেমন শাসনও করতে পারেন নি। তবে নিজে অল্প শিক্ষিত হলেও ছেলে বি.এ. পাশ করছে তাতেই গর্বিত। ছেলের কথা গর্বের সঙ্গে গ্রামের লোকজনের কাছে বলে বেড়ান। ছেলে যে তার প্রতি এইসব কাজের জন্য অসন্তুষ্ট তা বোঝেন। তাই তিনিও ছেলের প্রতি অসন্তুষ্ট। এখন তার কথা শুনে বললেন, এসব কেন করি, এতদিনে তোমার বোঝা উচিত ছিল। বুঝলে একথা বলতে না। মনে করেছিলাম, আমার বয়স হয়েছে, এবার তোমাকে মাতব্বরীটা দেব; কিন্তু তুমি তো আবার এসব পছন্দ কর না। যাক, এসব ব্যাপার নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না।
এরপর থেকে পারভেজ আব্বাকে কিছু বলে নি। আজ হাবিব ডাক্তার ভালো কিনা জিজ্ঞেস করতে ভাবল, তার সুনাম আব্বা সহ্য করতে পারছেন না। বলল, গ্রামের সবাইয়ের মুখে যখন হাবিব ডাক্তারের সুনাম তখন নিশ্চয় তিনি ভালো।
গ্রামের সবাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করি নি, তোমার মতামত জানতে চাইছি?
তার মতো ভালো মানুষ আজকালের যুগে দেখা যায় না।
তুমি তার পরিচয় জান?
জানব না কেন? তার সঙ্গে আমার খুব ভালো জানাশোনা।
কোথায় বাড়ি? কার ছেলে? তিনি কি করেন? এসব জান?
হাবিব ডাক্তারের সম্পর্কে আজরাফ হোসেন যা বলেছিলেন, পারভেজও তাই বলল।
মুশতাক বিশ্বাস অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমিও তাকে ভালো মনে করি। তাই কতটা ভালো তোমার কাছে জানতে চাইলাম। আচ্ছা, ডাক্তার বিয়ে করেছে কিনা জান?
না, উনি এখনো বিয়ে করেন নি।
তাই নাকি? আমি তো মনে করেছিলাম, বৌ, ছেলেমেয়ে আছে। ওদের পদবী কি জান?
হাবিব ডাক্তারের দাদাজী হাসিবুর রহমান বিশ্বাস বংশের ঔরসে জন্ম নিলেও তার খালা-খালু খাঁ বংশের এবং তারা তাকে মানুষ করেছিলেন বলে তিনি খান পদবী গ্রহণ করেন। তাই হাবিব ডাক্তার পারভেজকে বলেছিল, তাদের পদবী খান। এখন মুশতাক বিশ্বাস ছেলেকে তাদের পদবী জিজ্ঞেস করতে পারভেজ বলল, খান।
পদবী শুনে মুশতাক বিশ্বাস কপাল কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
পারভেজ বলল, ডাক্তারের পদবী খান শুনে মনে হচ্ছে বিরক্ত হয়েছেন?
মুশতাক বিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে বললেন, ভেবেছিলাম, ওর সঙ্গে আতিকার বিয়ে দেব; কিন্তু তুমি তো আমাদের বংশ গৌরব ও বংশের রীতিনীতি জান। বিশ্বাস বংশ ছাড়া অন্য কোনো বংশে আমরা ছেলেমেয়ের বিয়ে দিই না। বিশেষ করে খাঁ বংশকে আমরা কেন ঘৃণা করি, তা তুমিও জান। তাই ডাক্তার খা বংশের ছেলে জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আব্বার অসুখের সময় যখন হাবিব ডাক্তারকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করিয়েছিল, তখন তাকে আতিকার মতো পারভেজেরও খুব ভালো লেগেছিল। তারপর হেড স্যার আজরাফের কাছে পরিচয় জেনে তার প্রতি আরো ভক্তি-শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। তখন থেকে একটা কথা বারবার তার মনে হয়, ডাক্তারের সঙ্গে আদরের একমাত্র বোন আতিকার বিয়ে হলে সে সুখী হবে। কিন্তু আব্বা যে বিশ্বাস বংশ ছাড়া অন্য বংশে কিছুতেই আতিকার বিয়ে দেবেন না, তা জানে। তাই মনের ইচ্ছা এতদিন চেপে রেখেছিল। এখন আব্বার কথা শুনে সেই ইচ্ছাটা প্রবল হল। ভাবল, আব্বাকে যেমন করে তোক রাজি করাতেই হবে। তাই সাহস করে নিজের ইচ্ছার কথা বলে বলল, আজকাল কেউ বংশ বিচার করে না। বিচার করে ছেলের চরিত্র ও তাদের খানদান ভালো না মন্দ। ছেলে হিসাবে হাবিব ডাক্তার যে কত ভালো, তা আপনি, আমি ও গ্রামের সবাই জানে। আর তার বাবার সম্পর্কে যা জেনেছি, তাতে মনে হয়, তিনি ধনী ও উচ্চ খানদানী বংশের ছেলে। আমার মনে হয়, বিয়ের আগে বা পরে তার বাবার পরিচয় জানার পর কেউ বংশ নিয়ে কথা তুলবে না। তা ছাড়া আপনি বোধহয় জানেন না, ইসলাম শুধু নিচু বংশে মানে যারা নাকি ছোটলোক অসভ্য, নীচ তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে নিষেধ করছে। নচেৎ ইসলামে উঁচু নিচু বংশ বলে কিছু নেই। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে যারা আল্লাহকে ভয় করে তাঁর ও তাঁর রাসূল (দঃ) এর পথে জীবন পরিচালিত করে, তারাই দুনিয়াতে যেমন উচ্চ বংশ বলে পরিচিত, তেমনি পরকালেও আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা বেশি। আপনি আর অমত করবেন না আব্বা।
শাফিয়া বানু কিছুক্ষণ আগে এসে তাদের কথা শুনছিলেন, ছেলে থেমে যেতে বললেন, ডাক্তারকে আমারও খুব পছন্দ। আতিকার সঙ্গে মানাবে ভালো। পারভেজ ঠিক কথা বলেছে, তুমি রাজি হয়ে যাও।
মুশতাক বিশ্বাস ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তুমি এখন যাও। চিন্তা-ভাবনা করে দেখি। আর শোন, ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হলে একবার আমার কথা বলে আসতে বলবে।
পারভেজ চলে যাওয়ার পর শাফিয়া বানু বললেন, মেয়ের বয়স কত হল খেয়াল আছে? কবে থেকে তো পাত্র খুঁজছ, কই, কিছু করতে পারলে? আমি বলি কি হাবিব ডাক্তারকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না। খায়েদের হলে তো কী হয়েছে? ভালো ঘর ভালো ছেলে আজকাল পাওয়া খুব মুশকিল। এমন সোনার চাদ ছেলে পাবে কোথায়?
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, আমিও হাবিব ডাক্তারকে জামাই করতে চাই; কিন্তু গ্রামের লোক যখন জানবে খায়েদের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি তখন কী হবে?
কী আবার হবে? বিশ্বাস বংশের মধ্যে উপযুক্ত ছেলে না পাওয়া গেলে মেয়েকে কী চিরকাল আইবুড়ী করে ঘরে রেখে দেবে? তা ছাড়া ডাক্তার শহরের ছেলে, কোন বংশের ছেলে তা কি গ্রামের লোক জানছে? আর জানলেই বা কি? তোমার বিরুদ্ধে কারো কিছু বলার সাহস আছে নাকি?