উনি তো এখন প্রায় সুস্থ। সংসারের কাজকর্ম করতে পারেন। তবে ডাক্তার ভারি কোনো কাজ করতে ও বেশি হাঁটাহাঁটি করতে নিষেধ করেছেন।
হাবিব ডাক্তারের চিকিৎসায় নাকি সুস্থ হয়েছে?
হ্যাঁ, এখনো চিকিৎসা চলছে। সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ হিসাবে হাবিব ডাক্তারের মতো ছেলে হয় না।
এমন সময় যীনাত তিন কাপ চা ও বিস্কুট একটা ট্রেতে করে নিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, মাতব্বর চাচা কেমন আছেন?
মুশতাক বিশ্বাস তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।
যীনাত কিছু বলার আগে আজরাফ হোসেন বললেন, চিনতে পারলেন না? ওতো হাশেম আলি চাচার মেয়ে যীনাত।
কি করে চিনব বল, ওড়না দিয়ে যেভাবে মুখ ঢেকে রেখেছে।
একথা শুনে যীনাত ট্রে রেখে চলে গেল।
আজরাফ হোসেন বললেন, ওতো কখনও মুখ খোলা রেখে কারো সামনে আসে না। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় থেকে ঐভাবে মুখ ঢেকে স্কুলে যেত। আমি তো ওর চাচাত বড় ভাই। আমার সামনেও ঐভাবে মুখ ঢেকে আসে।
তাই নাকি? এতটা কিন্তু ভালো না। বড় ভাই বা বাপ-চাচার বয়সী লোকেদের সামনে মুখ খোলা রাখলে দোষ কি?
আমি ওকে একদিন সে কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, শরীয়তে যে চোদ্দজনকে বিয়ে করা হারাম বলা হয়েছে, তাদেরকে ছাড়া সবাইকেই পর্দা করতে হবে। যীনাত তো তবু পর্দা করে আমার সামনে আসে, চাচি আম্মাতো পর্দা করেও আসতেন না।
আজকাল তো শরীয়তের আইন কেউই মেনে চলে না। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে লেখাপড়া করছে? চাকরি-বাকরি করছে।
কেউ মেনে না চললেও যে মেনে চলে, তাকে কিছু বলা উচিত নয় বরং তাকে শ্ৰেণীমতো ভক্তি শ্রদ্ধা করা উচিত।
এই প্রসঙ্গ এড়াবার জন্য মুশতাক বিশ্বাস বললেন; ওকে আগে একবার দেখেছিলাম, এখনতো দেখছি বেশ মোটা-সোটা হয়েছে। তাই চিনতে পারি নি। তারপর হাশেম আলির বাস্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওখানে পাকা দালান দেখেছি, ওটা কার?
হাশেম আলি চাচার।
মুশতাক বিশ্বাস অবাক হয়ে বললেন, সে তো সব জমি-জায়গা বিক্রি করে দিয়েছে, পাকা দালান করল কি করে?
হাবিব ডাক্তার যীনাতকে বিয়ের আগে পাকা বাড়ি করে দিয়েছে। সে কথা কাউকে জানাতে নিষেধ করে দিয়েছিল। তাই আজরাফ হোসেন বললেন, আমিই করে দিয়েছি। বন্যায় মাটির বাড়ি ধ্বসে গিয়েছিল। ভাবলাম, মাটির বাড়ি করলে আবার যদি বন্যায় ধ্বসে যায়, তাই পাকাই করে দিলাম।
আজরাফ হোসেন যে খুব দিল-দরিয়া লোক, তা মুশতাক বিশ্বাস জানেন। বললেন, ভালই করেছেন, হাজার হোক চাচা তো। তা হাবিব ডাক্তার এদিকে আসে?
রুগী দেখতে এলে আসেন। তা ছাড়া আগে আমার স্ত্রীর পেটে যখন সন্তান আসে তখন থেকে মাসে একবার দেখতে আসতেন। চাচার অসুখের কথা জেনে তার চিকিৎসা করার জন্য আসতেন। এখনও আমার সন্তানকে ও চাচাকে দেখতে আসেন।
আচ্ছা মাস্টার, গ্রামের সবার মতো তুমিও তার প্রশংসা করলে; কিন্তু তার পরিচয় জেনেছ?
আপনি বোধহয় জানেন না, মানুষের ব্যবহারই তার বংশের পরিচয়।
তা আর জানব না? আমি বলছি কার ছেলে? কোথায় বাড়ি, এসব জান কিনা?
আজরাফ হোসেন জানেন, মাতব্বর কোনো মতলব ছাড়া স্বশরীরে কোথাও হাজির হন না। তাই তাকে একজন চামচাসহ আসতে দেখে যা অনুমান করেছিলেন, এতক্ষণ আলাপের মাধ্যমে তা দৃঢ় হল। বললেন, জানব না কেন? সুপ্রিমকোর্টের বিখ্যাত ব্যারিস্টার খলিলুর রহমানের চার ছেলের মধ্যে হাবিব ডাক্তার ছোট। ওর বাবার ঢাকায় কয়েকটা বাড়ি আছে। বড় ভাই পুলিশ বিভাগের ডি.জি.। মেজ ও সেজ ব্যবসা করে।
মুশতাক বিশ্বাস অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আজরাফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, হাবিব ডাক্তার বুঝি তোমাকে তাই বলেছে?
হ্যাঁ, আপনার কী বিশ্বাস হচ্ছে না?
বিশ্বাস হওয়া কি সম্ভব? ও যে তোমার কাছে গুল ছেড়েছে, এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? যদি অত নামি-দামি বড়লোকের ছেলে হবে, তা হলে শহরের আরাম-আয়েশ ছেড়ে এই অজপাড়াগাঁয়ে ডাক্তারী করতে আসবে কেন?
আমি তাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে, তিনি মহৎ গুণের অধিকারী। তাই অজপাড়াগাঁয়ের গরিব মানুষের সেবা করতে এসেছেন।
কথাটা মুশতাক বিশ্বাস অস্বীকার করতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কি জানি, হয়তো তোমার কথা ঠিক। যাক, এবার আসি হলে বলে মুশতাক বিশ্বাস চামচাকে বললেন, চল রে রসু, অনেক বেলা হয়ে গেল।
ফেরার পথে চিন্তা করলেন, যীনাত তার মায়ের মতো পর্দানশীল মেয়ে। সে কখনও ডাক্তারের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে না। আর ডাক্তারও সে ধরণের ছেলে নয়। হাশেম আলির চিকিৎসা করতে গেলে সে সময় হয়তো দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা হয়। আর সেটা দেখেই গিয়াস তাদের সম্পর্কে ঐরকম কথা বলেছে। সে রকম কিছু হলে আজরাফ মাস্টার নিশ্চয় জানতে পারত। জানার পর ডাক্তারের সঙ্গে সম্পর্কও রাখত না। আরো চিন্তা করলেন, আতিকা বলল, পারভেজ ডাক্তারের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। তাকেও জিজ্ঞেস করতে হবে। ডাক্তারদের পদবী কী জানতে হবে। সবকিছু মিলে গেলে আতিকার সঙ্গে বিয়ে দিলে ভালোই হবে।
বাড়িতে এসে এক সময় ছেলেকে বললেন, হাবিব ডাক্তারের সুনাম গ্রামের লোকের মুখে মুখে, সে কি সত্যিই ভালো?
পারভেজ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছে আব্বা তোষামোদী খুব পছন্দ করেন। কারো সুনাম সহ্য করতে পারেন না। সব সময় পরের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ান। সেজন্য দু’চারজন চামচা ধরনের লোক নিযুক্ত করেছেন। কারো দোষ-ত্রুটির খবর পেলে বিচার করেন। নিজের সুনাম শুনতে খুব ভালবাসেন। সেজন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রতিবছর যাকাত দেন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুলে অনেক টাকা দান করেন। গ্রামের গরিবদেরও কিছু কিছু দান করেন। পারভেজ আব্বার এসব কাজে সন্তুষ্ট না থাকলেও কখনো কিছু বলে নি। হজ্ব করে আসার পর পারভেজ ভেবেছিল, আব্বা এবার হয়তো ঐসব খেয়াল ত্যাগ করে আল্লা বিল্লাহ করে কাটাবেন। কিন্তু আগের মতই সবকিছু করতে দেখে একদিন বলল, আপনি মাতব্বরী ছেড়ে দেন। মাতব্বরী করতে গিয়ে যে সময় নষ্ট করেন, সে সময় আল্লাহর জিকির আজকার করুন।