গিয়াস বলল, মাতব্বর সাহেব, এসব কাজ কি আর তাড়াতাড়ি হয়। এতদিনে যা জেনেছি, বলছি। তারপর হাবিব ডাক্তারের সম্পর্কে যা জেনেছে বলল।
মুশতাক বিশ্বাসের মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, খুব সাবধানে হাশেম আলির বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখবে। হাবিব ডাক্তার তার মেয়ের সঙ্গে অসামাজিক কাজে জড়িত আছে কিনা জানবে। বেটা ঘুঘু দেখেছে ফঁদ দেখে নি। ডাক্তার হয়ে হুজুরগিরী ছাড়িয়ে দেব।
গিয়াস বলল, মাতব্বর সাহেব, আর একটা খবর আছে, নাদের আলি দু’কামরা পাকা দালান বানাচ্ছে।
কি বললে গিয়াস, নাদের আলি দালান বাড়ি বানাচ্ছে? যে নাকি কামলাগিরী করে পেট চালায়, সে আবার দালান বাড়ি বানায় কি করে?
আমিও তাই বলি। একদিন নাদের আলিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত টাকা কোথায় পেলে, দালান বাড়ি করছ?
বলল, কোথায় আবার পাব? আল্লাহ দিয়েছে!
হুঁ বলে মুশতাক বিশ্বাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, নাদের আলির টাকার উৎস খুঁজে বের করবে।
সে কথা বলা লাগবে না মাতব্বর সাহেব। আপনি বলার আগেই কাজে নেমে পড়েছি। তেমন কোনো সন্ধান পাই নি। তবে মাঝে মধ্যে নাদের আলিকে কার্পাসডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্সে যেতে দেখেছি। আর হাবিব ডাক্তারকেও নাদের আলির সঙ্গে মাঝে মধ্যে পথে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলাপ করতেও দেখেছি।
তোমার কি মনে হয়, হাবিব ডাক্তার দালান বাড়ি করার জন্য নাদের আলিকে টাকা দিচ্ছে?
ঠিক তা মনে হয় নি। তবে একটু সন্দেহ হয় আর কি?
এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি আমার চামচাগিরী কর? হাবিব ডাক্তারের কি এমন স্বার্থ যে, দালান বাড়ি করার জন্য নাদের আলিকে টাকা দেবে? শোন, নাদের আলির টাকার উৎস খোঁজার সাথে সাথে হাবিব ডাক্তারের সম্পূর্ণ পরিচয় জানার চেষ্টা করবে।
ঠিক আছে, তাই করব?
মুশতাক বিশ্বাস বুক পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে তার হাতে দিয়ে বললেন, এবার যাও।
গিয়াস দোতা হাসি দিয়ে বলল, আসি মাতব্বর সাহেব। তারপর সালাম দিয়ে চলে গেল।
মুশতাক বিশ্বাস তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, নাদের আলির টাকার উৎস যেমন করে তোক জানতে হবে। গিয়াস হাবিব ডাক্তারকে সন্দেহ করছে। কিন্তু সেই বা এত টাকা পাবে কোথায়? বেতন আর কত টাকা পায়? বড় জোর চার-পাঁচ হাজারের মতো? হঠাৎ মনে পড়ল, কয়েকমাস আগে হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে মেয়ের আলাপ করার কথা। ভিতর বাড়িতে গিয়ে মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, হাবিব ডাক্তার লোকটা কেমন বলতে পারিস?
আব্বাকে হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করতে শুনে আতিকা অবাক হল। সেই সাথে একটু ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, কেমন লোক তাতো তুমিও জান। তোমার যখন কঠিন অসুখ হয়েছিল তখন তিনিই চিকিৎসা করে ভালো করেছিলেন।
আমি তো জানি সে ভালো ডাক্তার। লোক হিসাবে কেমন জিজ্ঞেস করেছি।
লোক হিসাবেও খুব ভালো। তার মতো ভালো মানুষ আর দেখি নি।
তোর সঙ্গে দেখা হয়?
দেখা হয়, তবে ইদানিং দেখা হয় নি।
কিছুদিন আগে দেখলাম, তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলছিলি? তার পরিচয় জানিস না কি?
এই কথা শুনে আতিকা আরো ঘাবড়ে গেল। ভাবল, সেদিন আমাদের কথাবার্তা আব্বা শুনে নি তো? সামলে নিয়ে বলল, না আব্বা জানি না। তবে ভাইয়া জানে; সে হেড মাস্টার আজরাফ স্যারের কাছে শুনেছে।
ঠিক আছে তুই যা। তারপর মুশতাক বিশ্বাস চিন্তা করলেন, ছেলের কাছে জানার আগে আজরাফ মাস্টারের কাছেই শোনা দরকার।
সেখানে মুশতাক বিশ্বাসের স্ত্রী শাফিয়া বানু ছিলেন। মেয়ে চলে যাওয়ার পর বললেন, তোমার অসুখের সময় আমি হাবিব ডাক্তারকে দেখেছি, আতিকার কথাই ঠিক। আমার কাছেও খুব ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে।
মুশতাক বিশ্বাস স্ত্রীকে আদর করে শুধু বানু বলে ডাকেন। তার কথা শুনে বললেন, বলত বানু, হাবিব ডাক্তার কি আমার থেকে ভালো মানুষ?
শাফিয়া বানু এরকম প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। থতমত খেয়ে বললেন, এ আবার কি রকম কথা বলছ? “কি সে কী, আর পান্তাভাতে ঘি।” জান না, মেয়েদের কাছে স্বামী সবার থেকে বড়। তোমার মতো স্বামী পেয়ে আমি ধন্য।
মুশতাক বিশ্বাস তৃপ্তির হাসি হেসে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমার মতো স্ত্রী পেয়ে আমিও ধন্য।
শাফিয়া বানু বললেন, ছাড় ছাড়, কেউ এসে পড়বে। বুড়ো হলে তবু আগের মতো রয়ে গেলে।
মুশতাক বিশ্বাস হাসতে হাসতে বললেন, আরে বানু, মানুষ বুড়ো হলেও মন তো আর হয় না। মন চিরকাল কচিই থাকে।
থাক তুমি তোমার কচি মন নিয়ে। আমি চললাম সবাইকে খেতে দিতে হবে বলে শাফিয়া বানু চলে গেলেন।
পরের দিন সকালে রসু নামে আর একজন চামচাকে সঙ্গে নিয়ে মুশতাক বিশ্বাস পশ্চিমপাড়ায় আজরাফ মাস্টারের বাড়িতে গেলেন।
আজ কিসের জন্য যেন স্কুল বন্ধ। আজরাফ হোসেন বাড়িতে ছিলেন। তাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বললেন, কি সৌভাগ্য, মাতব্বর সাহেব হঠাৎ গরিবের বাড়ি? তারপর বৈঠকখানায় নিয়ে এসে বসতে বললেন।
বসার পর মুশতাক বিশ্বাস বললেন, শুনলাম এত বছর পর তোমার ছেলে হয়েছে?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা। দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন ওকে হায়াতে তৈয়েরা দান করেন।
তাতো করবই। তা তোমার হাশেম আলি চাচা কেমন আছে?