সাতদিনে আজরাফ হোসেন দু’টো খাসি জবেহ করে ছেলের নাম রাখলেন আবরার হোসেন। যার অর্থ ন্যায়বান সুন্দর। নামটা হাবিব ডাক্তার ঠিক করে দেয়। ঐদিন পাড়ায় গরিব-ধনী সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালেন। কার্পাসডাঙ্গার হেলথ কমপ্লেক্সের দু’জন ডাক্তার ও দু’জন নার্সকেও দাওয়াত করেছিলেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর সাগীর ডাক্তার ও নার্সদের হাবিব ডাক্তার বলল, আপনারা যান। আমার তো সাইকেল আছে, কিছুক্ষণ পর আসছি।
তারা চলে যাওয়ার পর আজরাফ হোসেনকে বলল, আপনি কী আমার প্রস্তাবটা নিয়ে যীনাতের আব্বার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন?
আজরাফ হোসেন বললেন, হ্যাঁ করেছি। উনি রাজি আছেন।
তা হলে এই আনন্দের দিনে আমি বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাই।
তার কথা শুনে আজরাফ হোসেন আনন্দিত হলেও অবাক হয়ে থতমত খেয়ে বললেন, আজ কী করে সম্ভব?
আল্লাহর মর্জি থাকলে সবকিছু সম্ভব। শুনুন, আমি এখন চলে যাচ্ছি, আপনাকে যেভাবে যা কিছু করতে বলেছিলাম, যীনাত ও তার আব্বার সঙ্গে আলাপ করে সে সব ব্যবস্থা করে রাখবেন। আমি রাত দশটার দিকে আসব। তারপর আজরাফ হোসেনকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সাইকেলে চেপে বসল।
আজরাফ হোসেন কিছুক্ষণ হাঁ করে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঘরে এসে স্ত্রীকে হাবিব ডাক্তারের কথা জানিয়ে বললেন, এখন কী করি বলতো?
তাসনিমা খাতুন বললেন, কী আবার করবে? উনি যেভাবে যা করতে বললেন, করবে। আমি তো অসুবিধে কিছু দেখছি না।
০৫. কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান
কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান খুব সৎ ও ধার্মিক। তার বাড়ি কুতুবপুর গ্রামের কাঁটাবাগান পাড়ায়। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো হলেও সংসারে অভাব অনটন নেই। মুশতাক বিশ্বাস টাকার জোরে কয়েকবার চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সৎ ও ধার্মিকতার কারণে অর্থবল না থাকলেও আজিজুর রহমানকে প্রতিবারেই জনগণ ভোট দিয়ে জিতিয়েছে। আর পনের বছর তিনি চেয়ারম্যানি করছেন। তার সুনাম সারা ইউনিয়নে। সরকারের কাছ থেকে যা কিছু সাহায্য আসে, তা জনগণের কল্যাণে ব্যয় করেন। তা থেকে তিনি এক কানাকড়িও যে আত্মসাৎ করেন না, সে কথা জনগণ জানে। তাই সকলের কাছ থেকে শ্ৰেণীমতো ভক্তিশ্রদ্ধা পান।
মুশতাক বিশ্বাস অল্প শিক্ষিত হলেও খুব চালাক চতুর লোক। তিনি গ্রামের মাতব্বর। লোক হিসাবে যে খুব খারাপ তা নয়, ধনীরা সাধারণত কৃপণ হয়, গরিবদের সাহায্যের নামে তাদের জমি-জায়গা আত্মসাৎ করে। কিন্তু তিনি সে রকম লোক নন। গরিবদের আপদে বিপদে সাহায্য করেন। নিয়মিত নামায রোজা করেন। হজ্বও করেছেন। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসার উন্নতির জন্য টাকা পয়সা দান করেন। তবু যে কেন তার সুনাম জনগণ না করে চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানের সুনাম করে, তা তিনি বুঝতে পারেন না। এক ধরনের মানুষ থাকে তারা বড়লোকী জাহির করতে চায়, অহঙ্কারী হয়, তোষামোদ ভালবাসে, অপরের মুখে সুনাম শুনতে পছন্দ করে, মুশতাক বিশ্বাস ঐ ধরনের লোক। তাই নিজেই লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে কয়েকবার চেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু হতে না পেরে আজিজুর রহমানের উপর ক্ষুব্ধ। কয়েকজন গুপ্তচর লাগিয়েছেন তার দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য, কিন্তু তাতেও সফল হতে পারেন নি। দুই রাজার মধ্যে যুদ্ধ হলে যিনি হেরে যান, তিনি যেমন রাজ্য হারাবার ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিজেতার বশ্যতা স্বীকার করে নেন, তেমনি আজিজুর রহমানের কাছে বারবার হেরে গিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনের খায়েশ চেপে রেখেছেন। তবে একদম হাল ছাড়েন নি। সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। ইদানিং হাবিব ডাক্তারের সুনাম লোকের মুখে মুখে জেনে পুরোনো স্বভাবটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই তার পিছনেও লোক লাগিয়েছেন দোষত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য।
গিয়াস খুব চতুর লোক। জমির ফসলে সারা বছরের খোরাকী হয়ে যায়। বাজার হাট করার জন্য মুশতাক বিশ্বাসের চামচাগিরি করে যা পায় তাতে চলে যায়। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ছোট সংসার। সারাদিন গ্রামে ঘুরে ফিরে লোকের ছিদ্র অন্বেষণ করে বেড়ায়, রাতে সে সব মুশতাক বিশ্বাসের কাছে তিলকে তাল করে বলে। মুশতাক বিশ্বাস তার উপরেই ভার দিয়েছেন হাবিব ডাক্তারের দোষ খুঁজে বের করার জন্য। বেশ কিছুদিন থেকে হাবিব ডাক্তারকে পশ্চিমপাড়ায় ঘন ঘন যেতে দেখে গিয়াস তাকে ফলো করে জানতে পারল, হেড মাস্টার আজরাফ হোসেনের সঙ্গে তার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আরো জানতে পারল, পঙ্গু হাশেম আলিকে ফ্রি চিকিৎসা করে ভালো করেছে এবং তার দু’বার বিধবা হওয়া মেয়ে যীনাতের সঙ্গে নিরিবিলিতে আলাপ করে। ইদানিং মাঝে মধ্যে বেশ রাতে তাকে পশ্চিমপাড়া থেকে ফিরতেও দেখেছে। তার সন্দেহ হল, তা হলে কি যীনাতের সঙ্গে ডাক্তারের কোনো অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে? কথাটাতো মাতব্বর সাহেবকে জানান দরকার?
প্রতিদিন বৈঠক খানায় এশার নামাযের পর ঘণ্টা খানেক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গ্রামের লোকজন মুশতাক মাতব্ববের কাছে আসে। আজও এসেছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর গিয়াসকে বসে থাকতে দেখে বললেন, কি গিয়াস, তুমি তো দেখছি কোনো কাজের লোক নও। প্রায় সাত আট মাস হয়ে গেল, হাবিব ডাক্তারের কোনো খোঁজ খবর দিতে পারলে না।