.
কিছুদিন পর যেদিন হাবিব ডাক্তার যীনাতের প্লাস্টার খুলে দিল, সেদিন যীনাত আপ্যায়ন করাবার সময় বলল, দু’একটা প্রশ্ন করব, কিছু মনে করবেন না বলুন?
মনে করার কি আছে, আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।
আমার সম্পর্কে সবকিছু জেনেও এই অজপাড়াগাঁয়ের মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন কেন? আপনি তো ঢাকার ছেলে, সেখানে ধনী ঘরের শিক্ষিত মেয়েরতো অভাব নেই?
আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব, তবে তার আগে আপনার মুখের নেকাব সরাতে হবে। এতদিন শুধু আপনার দুটো চোখ দেখে এসেছি।
বেগানা মেয়ের মুখ ইচ্ছা করে দেখা ইসলামে নিষেধ তাতো জানেন? হা জানি। তা হলে এরকম কথা বলছেন কেন? বিয়ের আগে ইসলামে পাত্র-পাত্রীকে একে-অপরকে দেখার অনুমতি যে আছে, তা বোধহয় জানেন না?
না, জানা ছিল না।
এবার তা হলে মুখটা খুলুন?
যীনাত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে দৃষ্টি নিচের দিকে করে রইল।
সুবহান আল্লাহ বলে হাবিব ডাক্তার তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হল, কোনো পরীকন্যা দেখছে। আরো মনে হল, মুশতাক বিশ্বাসের মেয়ে আতিকার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে যীনাত বলল, এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
আমার প্রস্তাবে রাজি আছেন কিনা জানার পর উত্তর দেব।
যার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন তার কাছ থেকে জেনে নেবেন।
তাতে নেবই। তবু এখন আপনার কাছে জানতে চাই।
পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা এখনও সরাসরি এরকম প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো এ্যাডভান্স হয় নি।
তা স্বীকার করছি। আপনাকে তাদের থেকে ব্যতিক্রম দেখে প্রশ্নটা করেছি। উত্তর দেয়াটা কিন্তু নির্লজ্জতা নয়, বরং ভালো।
রাজি বলে যীনাত লজ্জারাঙা হয়ে মুখ নিচু করে নিল।
আলহামদুলিল্লাহ বলে হাবিব ডাক্তার বলল, প্লীজ, মুখ তুলে আমার দিকে তাকান।
যীনাত কয়েক সেকেন্ড একইভাবে থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকাল।
হাবিব ডাক্তার দেখল, টানাটানা মায়াবী চোখ দুটো থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, তোমার মতো মেয়েকে আল্লাহ আমার তক্বদীরে জোড়া করেছেন। তাই শহরের কোনো মেয়েকেই আমার পছন্দ হয় নি। সেইজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।
তার কথা শুনে যীনাত আরো বেশি লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল। তারপর চোখ মুছে কাঁপা গলায় বলল, ঐ একই কারণে হয়তো দু’দু’টো স্বামীকে আল্লাহ বিয়ের রাতেই দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। তবু সেই ঘটনাগুলোর কথা ভেবে খুব ভয় পাচ্ছি।
তক্বদীরের উপর কারো হাত নেই। আল্লাহর উপর ভরসা কর। আর প্রত্যেক মুমীন মুসলমান নর-নারীর তাই করা ও উচিত। ইনশাআল্লাহ বিয়ে করে তোমার ভয় দূর করে দেব। আজ অনেক বড় দুশ্চিন্তা থেকে আল্লাহ আমাকে রেহাই দিলেন। সেজন্য আর একবার তার শোকরিয়া আদায় করছি। তারপর বলল, আমি তোমাকে তুমি করে বলছি। এখন থেকে তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।
মাফ করবেন, এখন থেকে বলতে পারব না, তবে বিয়ের পর—বলে লজ্জায় জিব কেটে চুপ করে গেল।
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, ঠিক আছে, তাই বলো। এখন একটা কথার উত্তর দাও তো, এতদিন নিজেকে অপয়া ভেবে বিয়ে করতে রাজি হও নি, এখন হলে কেন? তোমার আব্বাকে ও তোমাকে টাকা পয়সা না নিয়ে চিকিৎসা করে ভালো করেছি, সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য কী রাজি হয়েছ?
যীনাত কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বলল, আপনার ধারণা ভুল। আপনি যে বিনা টাকা পয়সায় আমাদের চিকিৎসা করছেন, তা জানতাম না।
তা হলে আসল কারণটা বল।
আপনি যে কারণে আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন, আমিও সেই কারণেই রাজি হয়েছি।
আমার ব্যাপারটা তুমি জানলে কেমন করে?
সে কথা বলতে পারব না। এবার নিশ্চয় আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন?
উত্তর তো তুমি জান, তবু বলতে বলছ কেন?
আমার ধারণাটা সত্য কিনা যাচাই করার জন্য।
যাচাই করা লাগবে না। তোমার ধারণাটাই সত্য।
এমন সময় হাশেম আলিকে আসতে দেখে হাবিব ডাক্তার সালাম বিনিময় করে বলল, কেমন আছেন?
আল্লাহর রহমতে ভালো আছি বাবা, তারপর মেয়ের পায়ে প্লাস্টার নেই দেখে বললেন, কী রে মা, এখন আর চলাফেরা করতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?
যীনাত আব্বাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তাকে নিজের চেয়ারে বসিয়ে বলল, না আব্বা, কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। তারপর একটা তাল পাখা এনে বাতাস দিতে লাগল।
ডাক্তারকে নাস্তা পানি কিছু দিয়েছিস?
চা-বিস্কুট দিয়েছি।
তা ছাড়া কিই বা দিবি মা? ঘরে তো….
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে হাবিব ডাক্তার বলল, এবার আসি চাচা। অনেকক্ষণ এসেছি। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
.
আজ তাসনিমা খাতুন চাঁদের মতো একটা ফুটফুটে ছেলে প্রসব করেছেন। আজরাফ হোসেনের ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। স্ত্রীর প্রসব ব্যথা উঠার কথা জেনে আজরাফ হোসেন নিজে কার্পাসডাঙ্গায় গিয়ে হাবিব ডাক্তারকে খবরটা দেন।
হাবিব ডাক্তার একজন নার্স সঙ্গে নিয়ে আসে এবং ঐ নার্সের তত্ত্বাবধানে প্রসব করায়।
প্রসবের পর যা কিছু করণীয় করার পর বিদায় নেয়ার সময় আজরাফ হোসেন নার্সকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে খুশি করলেন। হাবিব ডাক্তারকে খুশি করতে ইচ্ছা করলেও সে অপমানবোধ করবে ভেবে কিছু দিলেন না।