তাকে দেখে আজরাফ হোসেন সালাম বিনিময় করে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। তারপর যেতে যেতে বললেন, যীনাতের বোধহয় একটা পা ভেঙ্গে গেছে। আমি স্কুলে ছিলাম, আগুনের ধোয়া দেখে চলে আসি। তার আগেই যীনাত আহত হয়েছে। এসে শুনলাম, ও আমাদের রান্না করছিল। লোকজনের আগুন আগুন চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসে দেখে দাউ দাউ করে অনেক ঘরের সঙ্গে ওদের ঘরও পুড়ছে। ছুটে নিজেদের ঘরে গেল। চাচা ঘুমিয়েছিলেন। আগুনের তাপে যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন বেরোবার পথ ছিল না। লোকজন কেউ তাকে বের করে আনার সাহস পাচ্ছিল না। যীনাত গিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটা বস্তা নিয়ে পুকুরে গলা পর্যন্ত নামে তারপর বস্তাটা ভিজিয়ে গায়ে জড়িয়ে জ্বলন্ত ঘরে ঢুকে বস্তাটা চাচার গায়ে জড়িয়ে বের করে নিয়ে আসে। চাচার ও যীনাতের হাত-পা কিছুটা পুড়ে গেলেও মারাত্মক কিছু হয় নি। কিন্তু বেরিয়ে আসার সাথে সাথে ঘরের একটা আড়া তার ডান পায়ের উপর পড়ে। মেয়েরা ধরাধরি করে তাকে আমার ঘরে নিয়ে আসে।
ততক্ষণে তারা যে ঘরে হাশেম আলি ও যীনাত ছিল, সেখানে এসে গেল। হাবিব ডাক্তার তাদের দুজনের পোড়া জায়গাগুলো পরীক্ষা করে মলম লাগিয়ে দিল। তারপর যীনাতের পা পরীক্ষা করে প্লাস্টার করে দিয়ে সঙ্গে আনা কিছু ওষুধ খাওয়ার জন্য দিল এবং আরো কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে বলল, অন্য যারা আগুনে পুড়ে জখম হয়েছে, তাদের কাছে যাচ্ছি।
কয়েকদিনের মধ্যে বাপ-মেয়ের পোড়া ঘা ভালো হয়ে গেলেও যীনাতের প্লাস্টার একমাস পরে খোলা হল। কিন্তু পায়ে ভর দিয়ে চলতে পারছে না দেখে হাবিব ডাক্তার আবার প্লাস্টার করে দিল।
হাবিব ডাক্তার একদিন তাসনিমা খাতুনকে দেখতে এসে ফেরার সময় আজরাফ হোসেনকে জিজ্ঞেস করল, যীনাতকে আমার প্রস্তাবের কথা কী জানিয়েছেন?
আজরাফ হোসেন বললেন, হ্যাঁ, জানিয়েছি। সে রাজি আছে।
হাবিব ডাক্তার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বেশ কিছু টাকার একটা বান্ডিল তার হাতে দিয়ে বলল, ওদের দু’কামরা পাকা ঘর করে দেবেন। পরে আরো দেব।
আজরাফ হোসেনের খুব আপত্তি সত্ত্বেও প্রথম থেকে কোনো টাকা পয়সা না নিয়ে হাবিব ডাক্তার চাচার চিকিৎসা করছে। বাপ-মেয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়ার পরও যে চিকিৎসা করছে, সেজন্যেও কোনো টাকা পয়সা নেয় নি। আজ আবার তাদের পাকাঘর করে দেয়ার টাকা দিতে দেখে আজরাফ হোসেন যতটা না অবাক হলেন, তারচেয়ে বেশি অপমান বোধ করলেন। বললেন, এটা আপনার ঠিক হচ্ছে না। আমিই ভেবেছি, এবার চাচাকে পাকাঘর করে দেব। না-না, এ টাকা আমি নিতে পারব না বলে ফেরৎ দিতে গেলেন।
হাবিব ডাক্তার তার টাকাসহ হাতটা দু’হাতে ধরে বলল, মনে হচ্ছে, আপনি খুব অপমান বোধ করছেন। সেজন্য মাফ চাইছি। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনাকে অপমান করার ধৃষ্টতা আমার যেন কোনো দিন না হয়। আসলে হাশেম আলি চাচার মতো ভালো মানুষ আমি আর কাউকে দেখি নি। যীনাত যদি আমার প্রস্তাবে রাজি নাও হত, তবু তার ঘর করে দিতাম। ওঁকে আমি বাবার মতো শ্রদ্ধা করি। তাই ছেলে হয়ে বাবার জন্য কিছু করতে পারলে মনে শান্তি পাব, আর দুস্থকে সাহায্য করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) খুশি হবেন ভেবে এটা করে দিতে চাচ্ছি। তা ছাড়া ভেবেছি, বিয়ের পর আমি ওদের সংসারের সব দায়-দায়িত্ব বহন করব।
তার কথা শুনে আজরাফ হোসেন আর আপত্তি করতে পারলেন না। টাকাসহ হাতটা টেনে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, বিয়ের আগেই তা হলে ঘরের কাজ শেষ করতে চান?
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, সেটা যখন বুঝতেই পেরেছেন তখন আর জিজ্ঞেস করছেন কেন? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরের কাজ কমপ্লিট করুন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।
আজরাফ হোসেন হাবিব ডাক্তারকে যত জানছেন তত অবাক হচ্ছেন। কিছুক্ষণ তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে স্ত্রীকে ডেকে কথাটা জানালেন।
তাসনিমা খাতুনও হাবিব ডাক্তারকে যত জানছেন, তত অবাক হচ্ছেন। বললেন, সত্যি, ওঁর মতো মানুষ হয় না। যীনাতের ভাগ্য খুব ভালো, এরকম একজন মানুষকে স্বামী হিসাবে পাবে।
হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক। এজন্যেই বোধহয় আল্লাহ ওকে দু’দুবার বিয়ের রাতেই বিধবা করেছেন। যারা এতদিন ওকে অপয়া বলত, বিয়ের পর তারা ওর ভাগ্য দেখে হিংসা করবে।
তুমিও ঠিক কথা বলেছ। দোয়া করি, আল্লাহ ওদের জোড়া তাড়াতাড়ি কবুল করুক।
চাচার কাছে যীনাত আছে তুমি চাচাকে এখানে আসতে বল। এখনই সব কিছু জানাব। মনে হয় আপত্তি করবেন না, বরং খুশিই হবেন।
আমারও তাই মনে হয় বলে তাসনিমা খাতুন ভিতরে চলে গেলেন।
একটু পরে হাশেম আলি এসে বললেন, বৌমা বলল, তুমি নাকি ডেকেছ?
আজরাফ হোসেন বললেন, বসুন চাচা, জরুরী আলাপ করব।
হাশেম আলি তার সামনের চেয়ারে বসলেন।
টাকা দেয়ার পর হাবিব ডাক্তার যা কিছু বলেছে, আজরাফ হোসেন সে সব বলে বললেন, আমরা বিয়ের ব্যাপারে যীনাতের মতামত নিয়েছি। সে রাজি আছে।
প্রথম যেদিন হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে দেখতে আসে, সেদিন তাকে দেখে ও কথাবার্তা শুনে খুব ভালো লেগেছিল। তারপর তার চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে চলাফেরা করতে পারছে, সেজন্য আগের থেকে এমনি কৃতজ্ঞ ছিল। এখন টাকা পয়সা না নিয়ে চিকিৎসা করছে, পাকা ঘর করার জন্য টাকা দিয়েছে ও বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছে শুনে আরো বেশি কৃতজ্ঞতা বোধ করলেন। সেই সাথে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দিত হলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বললেন, তুমিই যখন আমাদের সব কিছু করছ তখন আমি কি আর বলব বাবা? ওর চিন্তা আমার বুকে পাথরের মতো এতদিন চেপে ছিল। আজ তা দূর করে আল্লাহ আমাকে মুক্ত করলেন। সেইজন্য তাঁর পাক দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাচ্ছি।