হাবিব ডাক্তার চলে যাওয়ার পর তাসনিমা খাতুন বারান্দায় এসে স্বামীর পাশে বসে বললেন, তোমাদের সব কথা শুনেছি। আমার মনে হয় ডাক্তারের প্রস্তাবে যীনাত রাজি হয়ে যাবে।
আজরাফ হোসেন কুঁচকে বললেন, হঠাৎ তোমার এরকম মনে হল কেন?
হঠাৎ নয়, যেদিন ডাক্তার প্রথম আমাকে দেখতে আসে, সেদিন থেকে যীনাতের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। কি যেন ভাবে, অনেক সময় মুখ ভার করে থাকে। মাঝে মাঝে খুব অন্যমনস্ক থাকে। ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। ওর এরকম পরিবর্তন দেখে মনে সন্দেহ হতে ব্যাপারটা জানার জন্য সচেতন হলাম। হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম, ডাক্তার এসেছে শুনে ওর মুখে খুশির আমেজ ফুটে উঠল। ভাবলাম, একটু আগে দেখলাম মুখ ভার করে কি যেন চিন্তা করছে, আর ডাক্তার আসার কথা শুনে খুশি হল কেন? তা হলে কি ডাক্তারকে ওর পছন্দ? আবার ভাবলাম, ওতো নিজেকে অপয়া মনে করে আর বিয়ে করতে চায় না। খুশি হওয়ার অন্য কারণ হয়তো থাকতে পারে অথবা আমার দেখার ভুলও হতে পারে। অন্যদিন ডাক্তার এলে এ রকম কিছু পরিবর্তন হয় কিনা দেখার জন্য সচেতন থাকলাম। তারপর যখনই হাবিব ডাক্তার আসেন তখনই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে আমার সন্দেহটা দৃঢ় হয়েছে। তাই বললাম, ডাক্তারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে।
তোমার কথা যেন আল্লাহ কবুল করেন। তবু কিন্তু আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, প্রায় বছর খানেক আগে আমার সহকারী শিক্ষক জাহাজপোতার আব্দুল বাসেত আমাদের বাড়িতে একদিন এসেছিল। সে সময় যীনাতকে দেখে পছন্দ করে। পরে একদিন স্কুলে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। যীনাতের যে আগে দু’বার বিয়ে হয়েছে সে কথা বলার পরও বিয়ে করতে চেয়েছিল। পাত্র হিসাবে আব্দুল বাসেত যে সবদিক থেকে যীনাতের উপযুক্ত তা জানতাম। তাই আমি রাজি হয়ে যীনাতকে অনেক বুঝিয়েছিলাম; কিন্তু ওতো সাফ বলে দিল আর বিয়ে করবে না।
তোমার কথা ঠিক। আব্দুল বাসেত মাস্টারকে হয়তো যীনাতের পছন্দ হয় নি। ওর কথা থাক। আমি আজই ডাক্তারের প্রস্তাব দেয়ার কথা বলে ওর মতামত পরীক্ষা করব।
ঠিক আছে। তাই কর বলে আজরাফ হোসেন বললেন, যোহরের নামাযের সময় হয়ে এল। যাই গোসল করে আসি।
বিকেলে যীনাত যখন ভাবির মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল তখন তাসনিমা খাতুন বললেন, হাবিব ডাক্তার মানুষটা কেমন বলতে পারিস?
যীনাত ভাবির চালাকি ধরতে পারল না। বলল, গ্রামের মানুষ তো হাবিব ডাক্তার বলতে পাগল। সবার মুখে মুখে তার সুনাম।
আর তোর মুখে বুঝি বদনাম?
যীনাত হেসে ফেলে বলল, তা কেন? তারমতো ভালো মানুষ জীবনে দেখি নি।
হ্যাঁ, তুই ঠিক কথা বলেছিস, আমারও তাই মনে হয়। আমিও তোর ভাইয়া চিন্তা করেছি, ডাক্তারের সঙ্গে তোর আবার বিয়ে দেব।
কথাটা শুনে যীজাতের হৃদয়ের রক্ত আনন্দে তোলপাড় শুরু করল। হাতের চিরুনী হাতে রয়ে গেল। হাতে যেন এতটুকু শক্তি নেই। স্ট্যাচুর মতো চুপ করে বসে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাসনিমা খাতুন বললেন, কী রে, কিছু বলছিস না কেন? চুলও আঁচড়াচ্ছিস না?
যীনাত সামলে নিয়ে চুলে চিরুনী চালাতে চালাতে বলল, তোমরা চিন্তা করলেও উনি আমার মতো অজপাড়াগাঁয়ের গরিব লোকের অপয়া মেয়েকে বিয়ে করতে যাবেন কেন? হয়তো ঢাকার বড়লোকের মেয়ে ওঁর জন্য অপেক্ষা করছে। ভাইয়াকে এ ব্যাপারে ডাক্তারকে কিছু বলতে নিষেধ করো।
তার কথা শুনে তাসনিমা খাতুন বুঝতে পারলেন, ডাক্তারের সঙ্গে বিয়েতে রাজি। বললেন, আর ডাক্তার যদি নিজে তোর ভাইয়ার কাছে প্রস্তাব দেয়?
উনি তা দিতেই পারেন না?
ধর, যদি দেন?
ততক্ষণে চুল আঁড়চান হয়ে গেছে। খোঁপা বেঁধে দিয়ে বলল, বললাম তো, উনি এরকম প্রস্তাব দিতেই পারেন না।
আর যদি বলি আমরা কিছু বলার আগেই আজ উনি প্রস্তাব অলরেডী দিয়ে ফেলেছেন।
হৃদয়ের আলোড়ন যীনাত এতক্ষণ সামলাতে পারলেও আর পারল না। পিছন দিক থেকে ভাবি বলে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, এই অপয়া হতভাগির কি এত সৌভাগ্য হবে?
আল্লাহ তক্বদীরে রাখলে অসম্ভবও সম্ভব হয়। ওবেলা সত্যি সত্যি উনি তোকে বিয়ের করার জন্য তোর ভাইয়ার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। তাই তো তোর মতামত জানার জন্য এতকিছু বললাম।
০৪. যীনাত মারাত্মক আহত
আজ নাদের আলির মুখে ঘরে আগুন লেগে যীনাত মারাত্মক আহত হয়েছে শুনে হাবিব ডাক্তার খুব আতঙ্কিত হল। তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে আসার সময় তার জন্য মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করে ভাবল, আজরাফ স্যার কি তাকে বিয়ের প্রস্তাবের কথা জানিয়েছেন?
তখন গ্রীষ্মকাল, গ্রামের প্রায় সবার মাটির দেয়াল হলেও ছাউনি খড়ের। আজকাল অবশ্য অনেকে দালানকোঠা করছে। রোদের তাপে খড়ের চাল এমনই গরম ছিল। আগুন লাগতে বারুদের মতো জ্বলে উঠে। প্রথমে জালালদের রান্নাঘরে কেমন করে জানি আগুন লাগে। তারপর সেই আগুন অন্যান্য ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
হাবিব ডাক্তার পশ্চিমপাড়ায় এসে দেখল, প্রায় বেশির ভাগ ঘর পুড়ে গেছে। মেয়েরা সব কান্নাকাটি করছে। পুরুষরা পোড়া বাঁশ কাঠ সরাচ্ছে। এসব দেখে তার চোখে পানি এসে গেল। দালানকোঠাগুলো ও আজরাফ স্যারের ঘর ঠিক আছে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল। তাকে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল।