গত মাসে যখন হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে দেখতে এসে সুযোগ পেয়ে যীনাতকে বলেছিল, আজরাফ স্যারের কাছে আপনাদের সবকিছু শুনেছি, আপনি যে আর বিয়ে কতে চান নি ও নিজেকে অপয়া ভাবেন, তাও শুনেছি। এটা কিন্তু ঠিক নয়। দুনিয়াতে অনেক মুসলিম মহিয়সী নারী ছিলেন, যারা একটা, দু’টো, এমনকি তিনটে স্বামী মারা যাওয়ার পরও নিজেদেরকে অপয়া না ভেবে আবার বিয়ে করেছেন। আর ধর্মে এ ব্যাপারে কোনো নিষেধও নেই।
উত্তরে যীনাত বলেছিল, সেইসব মুসলিম মহিয়সী নারীদের জীবনী পড়েছি এবং স্বামী তালাক দিলে অথবা মারা গেলে ধর্মেও যে দ্বিতীয় তৃতীয় অথবা চতুর্থ বিয়ে করতে নিষেধ নেই, তাও জানি। ঐসব মহিয়সী নারীরা উপযুক্ত পাত্র পেয়েছিলেন, তাই একটা, দু’টো এমনকি তিনটে স্বামী মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করেছিলেন।
হাবিব ডাক্তার অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, কোনো উপযুক্ত পাত্র যদি বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তা হলে?
আমার তো মনে হয় অপয়া মেয়ে বলে আমার যে অপবাদ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে, জেনেশুনে কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে না। আর যদি না জেনে কেউ আসে, তবে তাকে জানিয়ে দেব। তখন নিশ্চয় সে প্রস্তাব ফিরিয়ে নেবে।
ধরুন কেউ জেনেশুনে প্রস্তাব দিল, তখন?
তখন যদি পাত্রকে উপযুক্ত মনে করি, তা হলে অন্য কথা।
সেদিন আর কিছু না বলে হাবিব ডাক্তার ফেরার সময় চিন্তা করেছিল, একসময় আজরাফ স্যারকে যীনাতকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে দেয়া হয় নি। কয়েকদিন আগে তার স্ত্রীকে চেকআপ করতে গিয়ে চা-খাওয়ার সময় বলল, স্যার, আপনি যদি অভয় দেন, তা হলে একটা কথা বলতে চাই।
আজরাফ স্যার এতদিনে হাবিব ডাক্তারকে খুব সৎ, ধার্মিক ও সাহসী বলে জেনে এসেছেন। তাই আজ তার কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললেন, অভয় দেয়ার কথা বলছেন কেন বুঝতে পারছি না।
না, মানে আমি তো বাইরের লোক, কথাটা আপনাদের আত্মীয় সম্পর্কে। শুনে যদি আমাকে ভুল বোঝেন, তাই বলে থেমে গেল।
আজরাফ হোসেন আরো অবাক হয়ে বললেন, আপনাকে ভুল বুঝবো ভাবলেন কী করে? আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।
যীনাত কি এখানে আছে?
হাবিব ডাক্তারের মুখে যীনাতের নাম শুনে আজরাফ হোসেন আর একবার অবাক হলেন। কারণ এর আগে কখনও তার মুখে শোনেন নি। বললেন, না নেই। ওদের ঘরে গেছে।
আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। তবে খুব গোপনে। আপনারা দু’জন, আপনার চাচা, বিশ্বস্ত একজন লোক ও যিনি বিয়ে পড়াবেন, এই পাঁচজন ছাড়া অন্য কেউ যেন জানতে না পারে।
আজরাফ হোসেন এত অবাক হলেন যে, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। সেই সাথে আনন্দিতও কম হলেন না। ভাবলেন, আল্লাহ যীনাতকে এর সঙ্গে জোড়া করে রেখেছিলেন বলে হয়তো তার দু’বার বিয়ে হলেও কোনো স্বামীই তাকে স্পর্শ করার সুযোগ পায় নি। আর এই জন্যই বোধহয় আল্লাহ হাবিবকে ডাক্তার করে এই এলাকায় পাঠিয়েছেন।
তাকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে হাবিব ডাক্তার বলল, কথাটা বলে বোধহয় ভুল করে ফেলেছি, অনুগ্রহ করে মাফ করে দিন।
আজরাফ হোসেন মৃদু হেসে বললেন, আপনি ভুল করেন নি। আল্লাহর কুদরতের কথা চিন্তা করছিলাম। আপনার কথা শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। আমার স্ত্রীকে দিয়ে আপনার কথা যীনাতকে জানাব। যদি রাজি না হয়,
আমি বোঝাব। এবার আমি একটা কথা বলব, রাখবেন বলুন।
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, আমার পরিচয় জানতে চাইবেন তাই না?
আজরাফ হোসেন আবার অবাক হলেন। বললেন, কি করে বুঝলেন?
বোঝার আর অসুবিধে কোথায়? পাত্রের সবকিছু না জেনে কি মেয়ের গার্জেনরা বিয়ে দেন? না দেয়া উচিত?
আজ কিন্তু আপনি বারবার আমাকে অবাক করছেন?
হাবিব ডাক্তার আবার মৃদু হেসে বললেন, আমার পরিচয় শুনলে তো আবার অবাক হবেন।
তাই না কি? তা হলে দেরি না করে বলে ফেলুন।
তার আগে আপনাকে ওয়াদা করতে হবে, যা শুনবেন, তা কাউকে বলবেন না।
ঠিক আছে, ওয়াদা করলাম, আপনি বলুন।
হাবিব ডাক্তার অল্প সময় চুপ করে থেকে বলল, খাঁপাড়ার নাদের আলির পূর্ব-পুরুষদের সময় থেকে বিশ্বাসপাড়ার মুশতাক বিশ্বাসদের শত্রুতা কেন বলতে পারেন?
আজরাফ হোসেন বললেন, মায়ের কাছে শুনেছি, মুশতাক বিশ্বাসের দাদা হারুন বিশ্বাস খায়েদের একটা মেয়েকে ভালবেসে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। সে বিয়ে হারুন বিশ্বাসের বাবা রহিম বিশ্বাস মেনে নেন নি এবং ঐ বৌকে ঘরেও তুলেন নি। কিন্তু হারুন বিশ্বাস বাবার অগোচরে স্ত্রীর কাছে যাতায়াত করতেন। আর স্ত্রীকে ও তার বাপ-চাচাদের বলতেন, বাবার রাগ পড়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলে খাঁপাড়ায় যাতায়াত করে জেনে রহিম বিশ্বাস তার আবার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ততদিনে ঐ মেয়ের একটা ছেলে হয়েছে। তখন তার বয়স দুই মাস। হারুন বিশ্বাস আবার বিয়ে করবে শুনে খায়েরা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বাস বাড়িতে এসে প্রতিবাদ করেন এবং বৌ ঘরে তুলে নিতে বলেন। রহিম বিশ্বাস খায়েদের যা তা বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিতে চাইলে উভয় পক্ষ তর্ক বিতর্কে মেতে উঠেন। এক পর্যায়ে রহিম বিশ্বাস রেগে গিয়ে মেয়ের বাবাকে গুলি করেন। কিন্তু তার আগে মেয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং গুলি খেয়ে মারা যায়। তারপর অনেক দিন মামলা মোকদ্দমা চলেছিল। খায়েদের থেকে বিশ্বাসরা অনেক বেশি ধনী। টাকার জোরে তারা মামলায় জিতে গেলেন। মেয়েটার যে দুই মাসের ছেলে ছিল, তাকে আর এক খালা নিয়ে গিয়ে মানুষ করে। সেই ছেলে বড় হয়ে সেখানেই বিয়ে শাদী করে থেকে যায়। সে আর এই গ্রামে ফিরে আসে নি। এই পর্যন্ত বলে আজরাফ হোসেন বললেন। কিন্তু আপনি এসব কথা জানতে চাইলেন কেন?