শবনম মায়ের কাছে গিয়ে আতাহার আসার কথা বলে বলল, মেজভাইয়া নাস্তা দিতে বলল।
যুবাইদা খানম বললেন, ছেলেটা অনেক দিন আসেনি। টিনে মুড়ি আছে তেল মাখিয়ে দিয়ে আয়, আমি চা করি।
শবনম একটা প্লেটে মুড়িতে তেল মাখিয়ে একজগ পানি ও একটা গ্লাস নিয়ে এসে বলল, এগুলো ততক্ষণ খাও, আম্মা চা বানাচ্ছে একটু পরে আসবে। তারপর সে চলে গেল।
দুবন্ধুতে মুড়ি খেতে খেতে গল্প করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে শবনম দুকাপ চা নিয়ে এসে তাদেরকে দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল।
শবনম আসার একটু পরে যুবাইদা খানম এলেন।
ততক্ষণ ওদের চা খাওয়া হয়ে গেছে। আতাহার সালাম দিয়ে বলল, চাচী আম্মা কেমন আছেন?
যুবাইদা খানম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। বাবা। তোমার কথা নাসির উদ্দিনের কাছে শুনেছি। ঢাকায় চাকরি করছ, তাও শুনেছি। এর আগে দেশে আসনি?
না-চাচী-আম্মা, একবছর পর আসলাম।
তোমরা গল্প কর আমি যাই বলে তিনি চলে গেলেন।
শবনম ও আসমা বাড়ির ভিতরের দিকের রুমে পড়ে। আর নাসিরউদ্দিন ও কলিম উদ্দিন বারান্দার রুমে পড়ে। দুটো রুমের মাঝখানে জানালা আছে। মা আসার পর শবনম পড়ার রুমে গিয়ে জানালার পর্দা ফাঁক করে আতাহারের দিকে চেয়েছিল। আসমা ও কলিম উদ্দিন সকালে ভবানীপুর নানার বাড়ি গেছে। নাসির উদ্দিন খাটে বসেছে। তার পিছন দিকে জানালা। আতাহার চেয়ারে বসেছে। তার মুখ জানালার দিকে।
শবনম চলে যেতে আতাহারের মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ জানালায় তাকে দেখে তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
শবনম এই রুমে এসে খাতায় কিছু লিখে রেখেছিল। আতাহার তার দিকে তাকাতে সেটা দেখাল।
আতাহার পড়ল-কাল বেলা তিনটের সময় চৌধুরীদের বাগানে আসবে। লেখাটা পড়ে আতাহারের অশান্ত মন শান্ত হল। সে এই কথাটাই বলার জন্য অপেক্ষা করছিল। চোখের ঈশারায় সম্মতি জানিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। তারপর নাসির উদ্দিনকে বলল, এবার আসি?
নাসির উদ্দিন বলল, কয়েকদিন আছিস তো?
এক সপ্তাহ আছি। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
.
০৪.
পরের দিন যোহরের নামায পড়ে আতাহার খাওয়া-দাওয়া করল। তারপর কিছুক্ষণ। রেস্ট নিয়ে আড়াইটার সময় ঘর থেক বের হল।
রফিকা বেগম দেখতে পেয়ে বললেন, এত রোদে কোথায় যাবি?
আতাহার বলল, কাল রাতে তোমাকে ফুফুর জমি রেজিস্ট্রী দেওয়ার কথা বললাম না? সে ব্যাপারে উকিলের সঙ্গে দেখা করতে যাব। তার আগে আর একজনের সঙ্গে দেখা করব। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল।
শবনমকে দেখার জন্য তার মন ছটফট করছিল। তাই সময়ের আগেই বেরিয়ে পড়েছে। ওর সঙ্গে দেখা করে তারপর উকিলের কাছে যাবে।
টিফিনের পর ফোর্থ ক্লাস সোয়া দুটোই শেষ হতে শবনম শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিয়ে যখন চৌধুরীদের বাগানে এল তখন পুরো আড়াইটা।
দৌলতখান বাজার থেকে যে রাস্তাটা গুপ্তগঞ্জ বাজারের দিকে গেছে সেই রাস্তার পাশে চৌধুরীদের বাগান। চৌধুরী হুজুর এর মধ্যে বাগানের উত্তর দিকের গাছপালা কেটে দুটা টিনসেড বাড়ি করেছেন। ওনার ইচ্ছা শেষ বয়সে এখানেই আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করে কাটাবেন। বাগান ও বাড়ি দেখাশুনা করার জন্য আলমাস নামের একজন তোক রেখেছেন। সে স্ত্রী ও দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে থাকে। চৌধুরী হুজুরই তাদের সংসারের খরচ চালান। মাত্র মাস দুয়েক আগে বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার পর একদিন এসে দেখে শুনে আলমাসকে রাখার ব্যবস্থা করেন। তারপর ফিরে যাওয়ার সময় তাকে বললেন, আতাহার ও শবনম নামে দুটো ছেলেমেয়ে যদি এখানে আসে তা হলে তাদের আদর যত্ম করবে।
আজ তিন চার বছর হতে চলল, শবনম চৌধুরীদের বাগানে আসেনি। কিছুদিন আগে মেজ ভাইয়ের মুখে যখন শুনল, যারা বাগানটা কিনেছে তারা নাকি সেখানে বাড়ি করেছে। এখন ভাবল, আতাহার ভাই যে বলেছিল, ওখানে জ্বীন নেই, তার কথা ঠিক। জ্বীন থাকলে সেখানে বাড়ি ঘর করে লোকজন আছে কি করে? আজ স্কুল থেকে চৌধুরীদের বাগানে আসার সময় সেই সব কথা শবনমের মনে পড়ল। ভাবল, যারা। ওখানে বাস করছে, আজ আতাহার ভাইকে নিয়ে তাদের সাথে আলাপ করবে।
শবনম কাছে এসে দেখল, বাগানের একপাশের গাছপালা কেটে ছয় সাত হাত চওড়া রাস্তা করা হয়েছে। রাস্তার শেষ মাথায় দুটো টিনসেড ঘর। শবনম ঐ রাস্তা দিয়ে না গিয়ে যেখানে তারা আগে খেলাধূলা করত, সেদিকে যেতে যেতে আতাহারকে আসতে দেখে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়ল।
আতাহারও তাকে দেখতে পেয়েছে। কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, চল, আমাদের পুরোনো জায়গায় গিয়ে বসি।
শবনম সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, তাই চল। তারপর যেতে যেতে অভিমান। ভরা কণ্ঠে বলল, তোমার জান পাথরের মত শক্ত। নচেৎ এক বছর কি করে ছিলে?
আতাহার বলল, আর তোমার বুঝি খুব নরম, যা নাকি বিরহের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে?
শবনম দাঁড়িয়ে পড়ে তার মুখের দিকে চেয়ে ভিজে গলায় বলল, সে কথা আল্লাহকে মালুম। তোমার চিঠি পেতে দেরি হলে কত রাত যে কেঁদে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি, তা যদি জানতে তা হলে ….. বলে থেমে গেল। কান্নায় তখন তার গলা ধরে এল, আর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
আতাহার বলল, তা আমি জানি শবনম। কথাটা একটু রসিকতা করেই বলেছি। বলাটা যে ঠিক হয়নি, তা বুঝতে পারলাম। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে দিয়ে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে; আর কখনো বলব না। চল আমাদের পুরোনো জায়গাতে বসে দুজনে দুজনকে প্রাণভরে দেখব। কিন্তু কাঁদতে পারবে না। বলে দিচ্ছি। এতদিন পর এসে তোমার হাসি মুখ দেখতে চাই।