মনসুর ধার-দেনা করে এবং স্ত্রীর দ্বারা শ্বাশুড়ীর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে একটা চৌচালা টিনের ঘর করে সেখানে বাস করছে।
যতদিন মামা শ্বশুর, মানে মোজাম্মেল খন্দকার বেঁচেছিলেন, ততদিন তদের সঙ্গে বেশ সদ্ভাব ছিল। মোজাম্মেল খন্দকার মারা যাওয়ার পর তারা তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে ভিটে থেকে সরাবার ষড়যন্ত্র করল। সেই জন্য কারণে অকারণে তাদের সঙ্গে ঝগড়া। করতে শুরু করল। রমিসা এমন কথাও মামীকে বলতে লাগল, আমার মায়ের জায়গা ছেড়ে তোমরা চলে যাও।
এইসব ব্যাপার দেখে শুনে শাইমা বেগম মেয়েকে রাগারাগি করে বললেন, আমার জায়গায় আমি ভাইকে থাকতে দিয়েছি। তাতে তোদের কি? তোরা ওদেরকে তাড়াতে চাস কেন? ভাইকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছে। চার-চারটে এতিম ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবি যাবে কোথায়? আমি ভাইপোদের নামে ঐ জায়গা রেজিস্ট্রি করে দেব। দেখি তুই আর জামাই কেমন করে ওদেরকে তাড়াতে পারিস। ছোট ছোট মামাতো ভাইবোনদের জন্য তোর মায়া হয় না। লোকজন শুনলেই বা বলবে কি?
রমিসাও মায়ের উপর রেগে গিয়ে বলল, নিজের মেয়ের ছেলেমেয়ের চেয়ে ভাইয়ের ছেলেমেয়ের উপর তোমার দরদ যখন বেশি তখন তারাই তোমাকে দেখুক। আমরা আর তোমাকে দেখব না।
রমিসাকে পেটে ধরলে কি হবে, ছোটবেলা থেকে মুখরা ও ঝগড়াটে বলে শাইমা বেগম তাকে শাসন করেও ঠিক করতে পারেননি। তাই বরাবর তার প্রতি অসন্তুষ্ট। এখন মেয়ের কথা শুনে বললেন, তোরা আমাকে কি এমন দেখিস? জামাইটা শুধু মাঝে মধ্যে বাজার করে দেয়। আর যা কিছু করে আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা। অসুখে বিসুখে তোরা আমাকে দেখিস? ভাবি না দেখলে কবেই আমার কবরে ঘাস ফুটে যেত।
এরকম ঝগড়া প্রায়ই মা-মেয়ের মধ্যে হয়। এর মধ্যে আতাহার ঢাকা থেকে বাড়িতে এল। আতাহার যখন বাড়িতে থাকত তখন প্রায় বাজার থেকে ফুফুর জন্য ফল পাকাড়ি কিনে আনত। ফুফুর খোঁজ-খবর নিত। এবারে ঢাকা থেকে আসার সময় অনেক কিছু এনেছে। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার সময় শাইমা বেগম বললেন, রমিসা ও তার স্বামী তোদেরকে এখান থেকে তুলে দিতে চায় সে কথা তোর মা হয়তো তোকে বলেছে। আমার কথা হল, আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন ওরা কিছু করতে পারবে না। কিন্তু মরে যাওয়ার পর তোরা এখানে টিকতে পারবি না। তাই ভেবেছি, তোদের দুভাইয়ের নামে বাস্তুটা রেজিস্ট্রী দেব। তুই সেই ব্যবস্থা কর।
আতাহার বলল, ফুফু, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। আম্মা বলছিল, সরকারী টিউব ওয়েল ওদের ঘরের কাছে বলে কুলসুম ও খাদিজাকে পানি নিতে দেয় না। বলে এদিকে এলে হাত-পা ভেঙ্গে দেব।
শাইমা বেগম বললেন, আমি সবকিছু জানি, আমাকে কিছু বলা লাগবে না। নিজের চোখে দেখে ও কানে শুনে তোকে রেজিস্ট্রী করার কথা বললাম। জেনে রাখ, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। নিজের পেটের মেয়ে হলে কি হবে, পেটে হিংসা গিজগিজ করছে। জামাইটাও একই রকম। শিক্ষিত ছেলে দেখে মেয়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, শিক্ষিত ছেলে নিশ্চয় মেয়েমানুষের স্বভাব চরিত্র পাল্টাতে পারবে। ওমা, ভবলাম কি? আর হল কি? দুজনেই কাঁটায় কাঁটায়। আর একটা কথা তোকে বলি, কথাটা তোর ফুফার কাছে শুনেছিলাম। মৌলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর(রঃ) লেখা মেফতাহুল জান্নাত কেতাবে আছে, আগুন যেমন কাঠকে পুড়িয়ে ফেলে, হিংসা তেমনি মানুষের সব নেকীকে নষ্ট করে দেয়। তারপর শাইমা বেগম কিছুক্ষন স্বামীর স্মৃতিচারন করে ভিজে গলায় বললেন, খবরদার কোনোদিন অন্যের প্রতি হিংসা করবি না। এবারে কয়েকদিন থেকে জায়গাটা রেজিস্ট্রী করে নে। আমার বয়স হয়েছে, কবে বলতে কবে আল্লাহ আমাকে তুলে নেয় তার ঠিক কি?
আতাহার বলল, ঠিক আছে ফুফু, আমি সেই ব্যবস্থা করছি।
আসাঅব্দি শবনমকে দেখার জন্য আতাহারের মন ছটফট করছে। আজ শুক্রবার স্কুল বন্ধ। পথে দেখা হবে না। একবার চিন্তা করল, কাল স্কুল ছুটির পর পথে দেখা করবে। কিন্তু মনকে বোধ মানাতে পারল না। মসজিদে আসরের নামায পড়তে গেল। নাসির উদ্দিনও নামায পড়তে এসেছিল। নামাযের পর মসজিদ থেকে বেরিয়ে নাসির উদ্দিন প্রথমে আতাহারকে দেখতে পেয়ে সালাম দিয়ে বলল, কি রে কখন এলি?
আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, এই তো আজ সকালে। কেমন আছিস বল।
আল্লাহর রহমতে ভালো। তুই?
আমিও তাই। তারপর তার সাথে কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, এর সঙ্গে ওদের বাড়িতে গেলে শবনমের সঙ্গে দেখা হবে।
নাসির উদ্দিন বলল, কিরে চুপ করে আছিস কেন?
আতাহার শবনমের কথা চিন্তা করতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলা সামলে নিয়ে বলল, এ বছর তোদের সবার রেজাল্ট কেমন হল?
ভালো, সবাই পাস করেছি।
আতাহার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার তকদিরে আর লেখাপড়া হল না। তোরা ভালো রেজাল্ট করেছিস শুনে মনে একটু শান্তি পেলাম। তারপর বলল, চল চাচী-আম্মার সঙ্গে দেখা করে আসি।
শবনম উঠোন ঝাড় দিচ্ছিল। মেজ ভাইয়ের সাথে আতাহারকে দেখে তার মন আনন্দে ছলকে উঠল। ঝাড়টা একপাশে রেখে সালাম দিয়ে বলল, আতাহার ভাই কবে এলে?
আতাহার সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আজ দশটা-এগারোটার দিকে।
নাসির উদ্দিন শবনমকে বলল, যা, আম্মাকে গিয়ে বল, আতাহার এসেছে। আর আমাদের জন্য কিছু নাস্তা নিয়ে আয়। তারপর আতাহারকে বলল, আয় আমরা পড়ার ঘরে বসি।