শবনম বলল, শুনেছি ঢাকার মেয়েরা খুব বেপর্দা হয়ে চলাফেরা করে। তাদেরকে দেখে আমার কথা ভুলে যাবে না তো?
আতাহার মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, ছিঃ শবনম, একথা বলতে পারলে? আমরা দুজনে সেই ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। তখন থেকেই আমরা একে অপরকে ভালবেসেছি। ইনশাআল্লাহ যতদিন বাঁচব ততদিন সেই ভালবাসায় কোন চিড় ধরবে না। আল্লাহ ছাড়া আমার কাছ থেকে তোমাকে কেউ বিছিন্ন করতে পারবে না। তুমি শুধু দোয়া কর, আমি যেন স্বাবলম্বী হয়ে তোমার উপযুক্ত হতে পারি।
শবনম বলল, দোয়া তো নিশ্চয় করব। ওয়াদা কর, আমাকে তুমি ভুলে যাবে না।
আতাহার মৃদু হেসে বলল, করলাম। তুমিও কর।
শবনম তার পায়ে হাত দিয়ে ছালাম করে বলল, করলাম।
আতাহার ভিজে গলায় বলল, হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে ওয়াদা পূরণ করার এবং সবর করার তওফিক দাও। তারপর বলল, তোমাকে যেতে বলতে মন চাইছে না। তবু বলছি এবার বাড়ি যাও। তোমার মেজ ভাই নাসির উদ্দন আসছে। তারপর সালাম বিনিময় করে আল্লাহ হাফেজ বলে যার যার পথে চলে গেল।
নাসির উদ্দিন ও আতাহার ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে পড়েছে। দুজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা। কিন্তু নাসির উদ্দিন শবনম ও আতাহারের সম্পর্কের কথা জানে না। আতাহার ভেবে রেখেছে আগে স্বাবলম্বী হয়ে, তারপর জানাবে। এখন শবনমের সঙ্গে রাস্তায় কথা বলতে দেখে কিছু মনে করতে পারে ভেবে আতাহার অন্য পথ ধরল।
পরের দিন এগারটায় আতাহার ঢাকা রওয়ানা দিল। এর আগে কয়েকবার সে ঢাকা এসেছে। আতাহারের তিন মামা। বড় মামা হামিদ ঢাকায় সরকারী অফিসে চাকরি করেন। তিনি ঢাকায় ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। আর তার মেজ খালাও ঢাকায় থাকেন। খালু একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। আতাহার মামার বাসায় এসে উঠল। তারপর মামাকে চাকরির কথা বলল।
হামিদ বললেন, তুই এখনো ছেলেমানুষ, কে তোকে চাকরি দেবে। অন্তত ম্যাট্রিকটা পাস করলে কিছু একটা করা যেত। কত বি, এ, এম, এ,পাস ছেলে চাকরি পাচ্ছে না। যাক, কিছুদিন থাক, চেষ্টা করে দেখি যদি কোথাও লাগাতে পারি।
মামাদের বাসা থেকে খালাদের বাসা বেশি দূরে নয়। আতাহার খালুকেও চাকরির কথা বলল।
তার খালুর নাম হাবিব। তিনিও ঐ একই কথা বললেন। প্রায় ছয়মাস মামা ও খালুর বাসায় থেকে চাকরির চেষ্টা করতে লাগল। অবশেষে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে আটশো টাকা বেতনের চাকরি পেল। চাকরিটা খালুই ঠিক করে দেন। এর মধ্যে সে একবারও বাড়ি যায়নি। তবে মাকে ও শবনমকে চিঠি দিয়েছে। শবনমও প্রতি চিঠির উত্তর দিয়েছে।
আতাহার মামাদের বাসায় থেকে চাকরি করছে। তাই তার খরচ নেই। বেতনের টাকা থেকে সামান্য কিছু মামীর কাছে জমা রেখে বাকীটা মনি অর্ডার করে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। চাকরি পাওয়ার ছমাস পর সাত দিনের ছুটিতে প্রায় একবছর পর বাড়িতে রওয়ানা দিল।
ঢাকা সদরঘাট থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় ভোলার লঞ্চ ছাড়ে। পরের দিন সকাল আটটায় পৌঁছে। লঞ্চ থেকে নেমে প্রায় দশ বার মাইল বাসে করে দৌলতখান আসতে হয়। আতাহার যখন বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল তখন বেলা দশটা। মাকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছ আম্মা?
রফিকা বেগম আজ একবছর পর ছেলেকে দেখে চোখের পানি রাখতে পারলেন না। জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি বাবা। তুই কেমন ছিলি? মাকে ছেড়ে এতদিন থাকতে তোর কষ্ট হয়নি?
আতাহার বলল, হয়নি আবার; কিন্তু আম্মা নতুন চাকরি, বেতনও কম। ঘন ঘন আসার টাকা কোথায়?
রফিকা বেগম বললেন, হ্যাঁরে তুই যে তোর মামাদের বাসায় থাকিস, তোর মামী বিরক্ত হয় না তো?
না আম্মা, মামীর মত মেয়ে আজকাল দেখা যায় না। আমাকে নিজের ছেলের মত দেখে। মামা-মামী তোমাকে সালাম জানিয়েছে।
রফিকা বেগম ওয়ালাইকুম আসোলাম বলে বললেন, তুই তাদেরকে খুব মেনে চলবি। তাদের ছেলেমেয়েদের আদর করবি।
আতাহার হেসে উঠে বলল, সে কথা তোমাকে বলে দিতে হবে না। মামার দুটো ছেলে। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি, তারা সব সময় আমার কাছেই থাকে।
তা হারে, আমি যে গত চিঠিতে তোর মামা-মামীকে আসতে বলেছিলাম, তার কি হল কিছু শুনেছিস?
মামীর আসার খুব ইচ্ছা। মামা বললেন, এখন অফিস থেকে ছুটি দেবে না। পরে আসবেন।
তোর খালা-খালু কেমন আছে? তাদের কাছে যাতায়াত করিস তো?
কি যে বল আম্মা, যাব না কেন? মামাদের বাসা থেকে খালাদের বাসা পাঁচ মিনিটের রাস্তা। প্রায় প্রত্যেক দিনই যাই। মাঝে মাঝে সেখানে খাওয়া-দাওয়া করি।
এবার জামা কাপড় খুলে গোসল করে নে। আমি মুড়ি আর নারকেল এনে দিচ্ছি, খেয়ে ঘুমা। লঞ্চে কি আর ঘুম হয়েছে? রান্না করে তোকে জাগিয়ে খেতে দেব।
নদীতে বাস্তভিটে ভেঙ্গে যাওয়ার পর মোজাম্মেল খন্দকার যখন বোনের বাড়িতে এসে উঠেন, তার অনেক আগেই দুলাভাই মারা যান। বোনের একছেলে দুই মেয়ে। ছেলে ঢাকায় চাকরি করে এবং সেখানে বাড়ি করে ফ্যামিলি নিয়ে থাকে। বড় মেয়েও ঢাকায় থাকে। তার স্বামী ব্যবসা করে। ছোট মেয়ের বিয়ে তজুমদ্দিন গ্রামে দিয়েছেন। জামাই দৌলতখান বি. ডি. ও অফিসে কেরানীর চাকরি করে। তজুমদ্দিন দৌলতখান থেকে প্রায় দশ-এগার মাইল দক্ষিণে। তাই মেসে থেকে চাকরি করতো। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে থাকে। ঐ মেয়ের নাম রমিসা। আর জামাইয়ের নাম মনসুর। রমিসা যেমন মুখরা ও হিংসুটে, মনসুর তেমনি রাগি ও বদমেজাজী। সামান্য ব্যাপার নিয়ে প্রায়। প্রতিদিনই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ হয়। আর সেই কলহ পাড়া-পড়শী সবাই শুনে। প্রথম প্রথম তারা বিরক্ত হলেও পরে গা-সওয়া হয়ে গেছে। রমিসার মা শাইমা বেগম মেয়ে জামাইয়ের কলহ সহ্য করতে না পেরে বাস্তুর একদিকে কিছু অংশ মেয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়ে বললেন, তোমরা ওখানে ঘর করে নিজেদের সংসার নিয়ে থাক।