আতাহার এখন টেনে পড়ছে। শবনমের সঙ্গে আতাহারের সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়েছে। কিন্তু ইদানিং শবনমকে তার মা আতাহারের সঙ্গে মেলামেশা করতে দিচ্ছে না। মেয়ের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে রাগারাগি করে বলেন, তুই এখন বড় হয়েছিস। আগের মতো আতাহারের সঙ্গে মেলামেশা করলে লোকে মন্দ বলবে। শবনম মায়ের কথা কানে নেয় না। প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে আতাহারের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে তারপর বাড়ি ফিরে। ফলে প্রতিদিনই তাকে মায়ের বকুনী হজম করতে হয়।
এর মধ্যে আতাহারের বাবা মোজাম্মেল খন্দকার অসুস্থ হয়ে বাড়িতে এলেন। চট্টগ্রামে কোম্পানীর ডাক্তারকে দেখিয়েছেন। কিন্তু কোনো কাজ না হওয়াতে বাড়িতে আসেন। এখানকার ডাক্তার বললেন, এ রোগের চিকিৎসা বাড়িতে হবে না। ভোলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার তিন দিন পর মোজাম্মেল খন্দকার মারা গেলেন।
ওঁর মারা যাওয়ার খবর পেয়ে আতাহারদের বাড়ির সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।মোজাম্মেল খন্দকারের মৃত্যুর পর তাদের সংসারে দুর্যোগ নেমে এল। উনি চরফ্যাসনে বেশ কিছু জমি কিনেছিলেন। সেই সময় সার্ভিস থেকে অনেক টাকা তুলেছিলেন। মারা যাওয়ার পর মাত্র বিশ হাজার টাকার পাওনা ছিল। ঐ বিশ হাজার টাকা তুলতে অফিসারদের পেছনে আতাহারকে দশ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। বাকি দশ হাজার টাকা তোলার পিছনে তাকে বেশ কয়েক বার ঢাকা-চট্টগ্রাম ছুটাছুটি করতে হল। তাতে তার লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হল। তারপর ঐ টাকা দিয়ে আব্বার কুলখানি করার পর যা হাতে ছিল, তা থেকে আবার সভাই রহিমকেও দিতে হল।
আতাহার লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে কিছু করার চিন্তা ভাবনা করল।
রফিকা বেগম একদিন ছেলেকে ডেকে কষ্ট করে আর একটা বছর পড়াশোনা করে ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দিতে বললেন।
আতাহার বলল, সংসার কিভাবে চলবে সেই চিন্তায় আমার আর লেখাপড়া করতে মন চায় না। চরফ্যাসনের জমি থেকে যা ধান আসে তাতে ছয় সাত মাসের খোরাকী হয়। তারপর কি খাব। ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া, বাজার খরচ, কাপড়-চোপড় কিভাবে কেনা হবে ভেবে পাচ্ছি না। তাই ঠিক করেছি, ঢাকা গিয়ে একটি চাকরির চেষ্টা করব।
রফিকা বেগম বললেন, তুই ছেলেমানুষ। তার উপর তোর কোন ডিগ্রী নেই, তোকে কে চাকরি দেবে? তার চেয়ে একটু কষ্ট করে ম্যাট্রিকটা পাস করে নে। তারপর যা করার করবি।
আতাহার বলল, বললাম না, লেখাপড়া করতে আমার আর ভালো লাগে না। তারপর বলল, ঢাকায় বড় মামা আছে, খালা-খালু আছে। তাদেরকে ধরলে ইনশাআল্লাহ একটা কিছু ব্যবস্থা হবেই।
রফিকা বেগম বললেন, তুই যখন আমার কথা শুনবি না তখন তাই কর।
আতাহার অনেক দিন থেকে স্কুলে না গেলেও ছুটির সময় রাস্তায় শবনমের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন দেখা করে। প্রথম যে দিন আতাহার তাকে লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার কথা বলল, সেদিন শবনম তাকে অনেক কথা বুঝিয়ে লেখাপড়া ছাড়তে নিষেধ করল। তারপর আতাহার যখন তার আর্থিক অনটনের কথা বলল তখন শবনম চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমার একটা কথা রাখবে আতাহার ভাই?
অন্যায় না হলে নিশ্চয় রাখব।
আমি তোমার কাছে অন্যায় আব্দার করব, ভাবতে পারলে?
আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে মাথা ঠিক নেই। তাই হয়তো হঠাৎ ভুল করে কথাটা বলে ফেলেছি। মনে কষ্ট নিও না। বল কি তোমার আব্দার?
আমার জমানো কিছু টাকা আছে। দুটো আংটি একজোড়া কানের রিং একজোড়া। পার্শি বালি আছে। সে সব তোমাকে দেব। তুমি ঐসব বিক্রি করে এস, এস, সি পরীক্ষাটা অন্তত দাও।
শবনমের কথা শুনে আতাহারের চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, সংসার চলার মত অবস্থা থাকলে তোমার কথা নিশ্চয় রাখতাম। তারপর সেখান থেকে হনহন করে চলে গেল। এরপর থেকে শবনম লেখাপড়ার ব্যাপারে আর কিছু বলেনি।
ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আতাহার চরফ্যাসন গিয়েছিল জমি লাগিয়ে টাকা আনার জন্য। মোজাম্মেল খন্দকার প্রতি বছর চাষের সময় অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সেখানকার জমিতে ধান চাষ করতেন। আতাহারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রায় এক সপ্তাহ থেকে জমি বিলির ব্যবস্থা করে টাকা নিয়ে এসে মায়ের হাতে দিয়ে বলল, এই টাকায় যতটা সম্ভব ধান কিনে ফেলতে হবে।
রফিকা বেগম বললেন, তুই ঠিক কথা বলেছিস। তা না হলে খাব কি?
পরের দিন আতাহার বিকেলে শবনমের সঙ্গে দেখা করে বলল, দুএক দিনের মধ্যে আমি ঢাকায় চলে যাচ্ছি। সেখানে চাকরির চেষ্টা করব।
শবনম ছলছল চোখে চলল, তুমি এই কদিন আসনি কেন?
চরফ্যাসন গিয়েছিলাম জমির বন্দোবস্ত করতে।
আমাকে বলে গেলে না কেন?
রাতে মা বলল, তুই ঢাকায় চলে যাবি বলছিস, কাল সকালে চরফ্যাসন গিয়ে জমি লাগিয়ে টাকা নিয়ে আয়। পরের দিন সকালেই রওয়ানা দিই। তাই তোমাকে কথাটা জানাবার সুযোগ পাইনি।
শবনম চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, এই কদিন তোমাকে না দেখে আমি অস্থির ছিলাম। ঢাকায় গেলে থাকব কি করে?
আতাহার ভিজে গলায় বলল, তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমারও খুব কষ্ট হবে। তবু না গিয়ে উপায় নেই। তোমাকে তো আমাদের সংসারের সব কথা বলেছি। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে দেখে আবার বলল, কাঁদছ কেন? আমি তোমাকে স্কুলের ঠিকানায় প্রতি মাসে চিঠি দেব। তুমিও দেবে। আর দোয়া করো, আল্লাহ যেন আমার ও তোমার মনস্কামনা পূরণ করে। তারপর চোখ মুছে দিয়ে বলল, এবার হাসি মুখে আমাকে বিদায় দাও। যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে আর হয়তো দেখা হবে না।