মোজাম্মেল খন্দকার চেষ্টা চরিত্র করে বরিশালের পাতারহাটে নির্বাহী অফিসে রহিমকে চাকুরিতে ঢুকিয়ে দেন। রহিম একজনের বাড়িতে লজিং থাকত। তাদের দুটো ছেলেমেয়েকে সকালে ও রাত্রে পড়াতো। মেয়েটা তখন ক্লাস এইটে পড়ত। তার নাম সালেহা। ক্রমে সালেহা ও রহিমের ভালবাসা হয়। সালেহার মা-বাবা জানতে পেরে। তাদের বিয়ে দিয়ে দেন।
পরে মোজাম্মেল খন্দকার জানতে পেরে ছেলের উপর রাগ করে তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার এক বছর পর উনি আবার রফিকা বেগমকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহন করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে আতাহার। তারপর দুই মেয়ে কুলসুম ও খাদিজা। সর্ব কনিষ্ঠ আনোয়ার। সৎ ছেলে বিয়ে করেছে শুনে রফিকা বেগম স্বামীকে বুঝিয়ে ছেলে- বৌকে বাড়িতে আনেন। মোজাম্মেল খন্দকার ছেলে- বৌকে গ্রহন করলেও বাড়িতে এনে ভিন্ন করে দেন। রহিম। মনে কষ্ট পেয়ে এক বাড়িতে না থেকে পাশে জায়গা কিনে বাড়ি করে সেখানে থাকে।
সালেহা বনেদী ঘরের মেয়ে। শ্বশুর তাদেরকে আলাদা করে দিলেও শ্বশুর শ্বাশুড়ীকে যেমন ভক্তি শ্রদ্ধা করে, তেমনি সৎ ননদ ও দেবরদের আদর যত্ন করে।
ঐ দিন আতাহার শবনমদের বাড়ি থেকে ফিরে এসে মাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আম্মু, চৌধুরীদের বাগানে কি সত্যি সত্যি জ্বীন আছে?
রফিকা বেগম ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ আছে। কিন্তু তুই এখনও ছেলেমানুষ, জ্বীনদের কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
আতাহার বলল, আমি ও শবনম চৌধুরীদের বাগানে রোজ খেলতে যাই। সে কথা ওর আম্মা জানতে পেরে জ্বীনের কথা বলে ওখানে খেলতে যেতে নিষেধ করে বললেন, জ্বীনেরা মানুষের ক্ষতি করে। তোমরা কোনোদিন ওখানে খেলতে যেওনা।
রফিকা বেগম শবনমকে তাদের বাড়িতে অনেকবার আতাহারের সঙ্গে এসে। খেলাধুলা করতে দেখেছেন। সুন্দর ফুটফুটে শবনমকে তিনি খুব স্নেহ করেন। আদর করে কিছু না কিছু খেতে দেন। আজ ছেলের কথা শুনে বললেন, শবনমের আম্মা ঠিক কথা বলেছেন। আমিও তো তোকে ওখানে যেতে নিষেধ করেছি। তবুও যাস কেন? আর কোনোদিন যাবি না। জ্বীনদের ছোট ছেলেমেয়েদের উপর খুব লোভ। ফাঁক পেলে তুলে নিয়ে কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারে না।
তারপর থেকে আতাহার শবনমকে নিয়ে তাদের বাড়ির পিছনে বাগানে খেলা করে। শবনমের নানা জমি ভরাট করে এখানে সুপারি, নারিকেল, আম ও কাঁঠাল গাছ লাগিয়েছেন। এখন এইসব গাছে প্রচুর ফল হয়। বাগানটাও খুব বড়। এখানে খেলাধুলা করলেও আতাহারের মন চৌধুরীদের বাগানে যাবার জন্য ছটফট করে। এক ছুটির দিনে নাস্তা খেয়ে একা সেখানে গেল। যেখানে তারা খেলা করত, সেখানে বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবতে লাগল, আজ যদি জ্বীন আসত, তা হলে দেখতাম জ্বীন দেখতে কেমন। হঠাৎ একটা বয়স্ক দাড়ীওয়ালা পাজামা পাঞ্জাবী পরা ও মাথায় টুপি দেওয়া লোককে। বাগানের ভিতর থেকে আসতে দেখে অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল।
লোকটা কলাকোপা সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। নাম মহিউদ্দিন চৌধুরী। অত্যন্ত ধার্মিক। উনি জৌনপুর পীর সাহেবের খলিফা। সে জন্য অনেকে ওঁর হাতে বায়াত হয়েছেন। সবার কাছে উনি চৌধুরী হুজুর নামে খ্যাত। ওঁর কোন ছেলেমেয়ে নেই। ওঁরা দুভাই। ছোট ভাইয়ের একটা ছেলেকে পালক নিয়েছেন। সে দাখিল নবমে পড়ে। উনিই বাগানটা কিনেছেন। আজ দৌলতখান বাজারে একটা দরকারে এসেছেন। তাই আসার পথে বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। একটা ছেলেকে এই নির্জন বাগানে বসে থাকতে দেখে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলে, কে তুমি?
আতাহার সালাম দিয়ে বলল, আমি এই গ্রামের মোজাম্মেল খন্দকারের ছেলে।
চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, এখানে বসে আছ কেন? জান না এখানে জ্বীন থাকে?
জী জানি। জ্বীন দেখব বলেই তো বসে আছি।
চৌধুরী হুজুর অবাক হয়ে বললেন, জ্বীন কি, তা কি জান?
জী জানি। জ্বীন আগুনের তৈরী। তাদের মধ্যে ভালো মন্দ দুই-ই আছে। যারা মন্দ তারা মানুষের ক্ষতি করে। তবে আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
কেন?
আমি অজু করে তিন স্কুল পড়ে গা বন্ধ করে এসেছি।
চৌধুরী হুজুর তার পাশে একটা গাছের শিকড়ে বসে মৃদু হেসে বললেন, কার কাছে এসব শিখেছ?
আম্মার কাছে।
তোমার আম্মা জানেন, তুমি এখানে এসেছ?
না। আম্মা এখানে আসতে নিষেধ করেছেন। আমি লুকিয়ে এসেছি।
এটা তুমি ঠিক করোনি। তুমি তো দেখছি খুব ভালো ও বুদ্ধিমান ছেলে। ভালো ছেলেরা আম্মার কথার অবাধ্য হয় না। তুমি হলে কেন?
আমি আম্মা ও আব্বার কথার অবাধ্য হই না। জ্বীন দেখার আমার খুব সখ। তাই আম্মার শুধু এই নিষেধটাই শুনিনি।
চৌধুরী হুজুর বুঝতে পারলেন, ছেলেটা ভবিষ্যৎ জীবনে উন্নতি করবে। তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বললেন, কতদিন থেকে এখানে আসছ?
আগে আমি ও শবনম এখানে প্রতিদিন খেলাধুলা করতে আসতাম। শবনমের আম্মা জানতে পেরে আমাদেরকে জ্বীনের কথা বলে এখানে আসতে নিষেধ করেন। তারপর থেকে আমরা আর আসিনি। আজ জ্বীন দেখব বলে আমি একা এসেছি।
হুজুর বললেন, শবনম কে?
আমাদের পাড়ার সাখাওয়াত চাচার মেয়ে। ক্লাস সিক্সে পড়ে।
তুমি কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস এইটে।
তোমার রোল নাম্বার কত?
এক।
শবনমের রোল নাম্বার জান?