সাখাওয়াত হোসেনের বরাবর ইচ্ছে ছিল, আতাহারের সঙ্গে শবনমের বিয়ে দেওয়ার। স্ত্রী ও বড় মেয়ে এবং বড় ছেলের কথার চাপে সে কথা প্রকাশ করতে পারেননি। তার উপর আতাহারের নামে নানা রকম দুর্নাম শুনে মন ভেঙ্গে গিয়েছিল। এখন চৌধুরী হুজুরের কথা শুনে বুঝতে পারলেন, কেন উনি শবনমের বিয়ে দিতে নিষেধ করেছিলেন। হয়তো এটাই আল্লাহ পাকের ঈশারা। বললেন, আপনি যা বলবেন তাই করব হুজুর।
যা বলার আমি বলেছি। এবার আপনি আসুন।
ওদের বিয়ের সময় আপনাকে থাকতে হবে।
খবর দেবেন, আল্লাহপাক রাজি থাকলে নিশ্চয় থাকব।
চৌধুরী হুজুরের কথা শোনার পর থেকে আতাহারের মনে আনন্দের বান বইতে শুরু করেছে। ফেরার সময় সারা পথ শবনমের চিন্তায় ডুবে রইল। বাস থেকে দৌলতখান নেমেই মসজিদে গিয়ে শোকরানার নামায পড়ল। তারপর বাড়িতে এল।
রফিকা বেগম অনেক দিন ছেলের মুখে হাসি দেখেননি। আজ আগের মতো তার মুখে হাসির আভা দেখে খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চৌধুরী হুজুর ডেকেছিলেন কেন?
আতাহার কি বলবে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তোমাকে বলিনি, উনি মাঝে মাঝে আমাকে ডেকে পাঠাতেন এবং আমি গেলে অনেক সৎ উপদেশ দিতেন। আজও সেজন্যে ডেকেছিলেন। বিয়ের কথাটা লজ্জায় বলতে না পেরে মাথা নিচু করে নিল।
তাকে লজ্জা পেতে দেখে ও তার কথা শুনে রফিকা বেগমের মনে সন্দেহ হল। ভাবলেন, শুধু ভালো উপদেশ শুনে আতাহার এত খুশি হতে পারে না এবং মুখেও লজ্জা ফুটে উঠতে পারে না। নিশ্চয় উনি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা লজ্জায় বলতে পারছে না। বললেন, তা না হয় বুঝলাম; কিন্তু তুই এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমি তোর আম্মা, আমার কাছে বলতে তোর লজ্জা কিসের?
আতাহার বলল, উনি এবার আমাকে বিয়ে করতে বললেন?
রফিকা বেগম হেসে ফেলে বললেন, এই কথায় এত লজ্জা পাবার কি আছে? উনি ভালো কথাই বলেছেন। কয়েকদিন আগে ফজল ঘটক এসেছিল। আমিও এবার তোর বিয়ের কথা চিন্তা করে তাকে ভালো মেয়ে দেখতে বলেছি।
আতাহার বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, চৌধুরী হুজুর বললেন, মেয়ের বাবা নাকি নিজেই প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। আমার কি মনে হয় জান আম্মা, উনি হয়তো কোনো মেয়ের বাবাকে পাঠাবেন।
রফিকা বেগম বললেন, তা হলে তো ভালই হল। উনার পছন্দের উপর তো কোনো কথাই নেই।
আজ আলমাস আতাহারকে চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠানোর কথা বলে সাখাওয়াত হোসেনের বাড়িতে গিয়ে তাকেও একই কথা বলেছিল। কলাকোপা যাওয়ার সময় তিনি স্ত্রীকে সে কথা বলে গিয়েছিলেন।
স্বামী ফিরে আসার পর যুবাইদা খানম জিজ্ঞেস করলেন, চৌধুরী হুজুর ডেকেছিলেন কেন?
সাখাওয়াত হোসেন কি বলবেন, আসার পথে ভেবে রেখেছিলেন। বললেন, তিনি আমাদের পরিবারের সব খবর জানেন। শবনমের বিয়ে যাতে তাড়াতাড়ি হয় সে জন্যে তদবিরের কথা বলতে বললেন, তদবির লাগবে না। আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় অতি সত্ত্বর ওর বিয়ে হবে। তারপর আতাহারের কথা বলে বললেন, শবনমের উপযুক্ত হল আতাহার। আল্লাহ চাহে তো আপনার মেয়ে সুখী হবে। আমাকে চিন্তিত দেখে আবার বললেন, চিন্তা করছেন কেন? আপনারা হয়তো জানেন না, আতাহার বি, এ, পাশ করে ভালো চাকরি করছে। এই জমানায় ওর মতো ভালো পাত্র আর পাবেন না। আপনি নিজেই প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। আরো বললেন, আতাহারের বাবার চরের জমির ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে।
স্বামীর কথা শুনে যুবাইদা খানম এত অবাক হলেন যে, কোনো কথা বলতে পারলেন না। এক দৃষ্টে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সাখাওয়াত হোসেন মৃদু হেসে বললেন, তুমি খুব অবাক হচ্ছ, তাই না? হওয়ারই কথা। চৌধুরী হুজুরের কথা শুনে আমার অবস্থাও তোমার মতো হয়েছিল। আমি চিঠি দিয়ে সামসুদ্দিন, নাসির উদ্দিন, খালেদা ও জামাইকে আসতে বলি। তাদেরকে চৌধুরী হুজুরের কথা বলে তাড়াতাড়ি শবনমের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
শবনমও জানত, আব্বা চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। তাই ফিরে এসে আম্মার সঙ্গে কথা বলতে দেখে দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ তাদের কথাবার্তা শুনছিল। ঐ পর্যন্ত শুনে সে আর স্থির থাকতে পারল না। নিজের রুমে এসে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বেশ কিছুক্ষণ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করল। তারপর দুরাকায়াত শোকরানার নামায পড়ে চিন্তা করল, আতাহার ভাই তা হলে আমাকে পাওয়ার জন্য এতদিন সাধনা করেছে। কিন্তু আমার দেওয়া কয়েকশ চিঠির উত্তর দিল না কেন? অন্ততঃ একটা চিঠি দিয়ে আমাকে জানাতে পারত। নাসির উদ্দিন তো আমাদের সম্পর্কের কথা জানে, তার কাছেও বলতে পারত।
মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কয়েকশো চিঠি দিয়ে যখন শবনম একটা চিঠিরও উত্তর পেল না। তখন মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে মনের কামনা-বাসনা জানিয়েছে এবং সবর করার তওফিক চেয়েছে। আজ আব্বার মুখে তার কথা এবং তার সঙ্গে বিয়ের কথা শুনে একদিকে যেমন আনন্দে আত্মহারা হল, অপর দিকে তেমনি চিঠির উত্তর না দেওয়ার জন্য আতাহারের উপর প্রচন্ড অভিমান হল। ভেবে রাখল, আল্লাহপাকের ঈশারায় সময় হলে এর প্রতিশোধ নেবে।
আতাহার এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর শবনমকে চিঠি লিখতে বসল।