এতদিনে কুলসুমের সঙ্গে নাসির উদ্দিনের সম্পর্ক আরো গম্ভীর হয়েছে। সে কথা এরা দুজন ছাড়া অন্য কেউ না জানলেও শবনম জানে। শবনম বি, এ, পাশ করার পর আব্বা বড় ভাই ও মেজ ভাইয়ের সাহায্যে উঠোনের একপাশে ঘর উঠিয়ে বয়স্ক মেয়েদের জন্য একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছে। সেখানে গ্রামের মেয়েদেরকে ইসলামিক জীবন পদ্ধতি শিক্ষা দেয়। সেই সঙ্গে কোরআন ও নামায পড়া শেখায়। কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা পড়ায় এবং বিভিন্ন মাসালা-মাসায়েলও শিক্ষা দেয়।
আতাহার চৌধুরী হুজুরের কথা মতো চলে বি, এ, পাশ করার পর আগের অফিসেই উঁচু পদে চাকুরী করছে। ঘরের সংস্কার করিয়েছে। কুলসুম কে এস, এস, সি পাশ করার পর কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে। খদিজা এইটে পড়ছে। আর তার ছোট ভাই আনোয়ার এ বছর সেভেনে উঠেছে।
এবারে বাড়িতে এসে আতাহার শুনল, নদীতে চর জেগেছে। সরকার থেকে চরের জমি বিলি হচ্ছে। যাদের জমি জায়গা সেখানে ছিল, তারা চরের দখল নেবার জন্য। সরকারী লোকের কাছে কাগজ-পত্র নিয়ে ছুটোছুটি করছে। চৌধুরী হুজুর আতাহারকে জানিয়েছিলেন, আমি না জানান পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে না। এই প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে উনি পাঁচ বার দেখা করতে বলেছিলেন। এখন চরের জমির ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে পরামর্শ করবে কিনা দুদিন ধরে চিন্তা করে কাটাল।
তৃতীয় দিন সকালে নাস্তা খেয়ে উঠেছে এমন সময় ছোট ভাই আনোয়ার এসে বলল, আলমাস নামের একজন লোক আপনাকে ডাকছে।
আতাহার বাইরে এসে আলমাস কে দেখে সালাম দিয়ে বলল, কি খবর চাচা।
আলমাস সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তোমাকে চৌধুরী হুজুর দেখা করতে বলেছেন। উনি এখন কলাকোপায় আছেন। একজন লোক এসে খবরটা দিয়ে গেল। আমি খবরটা পেয়েই তোমাকে বলতে এলাম।
আতাহার বলল, ঠিক আছে চাচা, এক্ষুণি আমি রওয়ানা দেব। আপনি বসবেন আসুন, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।
আলমাস বলল, না বাবা, এখন চা খাবার সময় নেই। আরো এক জায়গায় যেতে হবে।
আতাহার আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করে ঘরে এসে মাকে চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠাবার কথা বলে কলাকোপায় রওয়ানা দিল।
আতাহার চৌধুরী হুজুরের বাড়িতে পৌঁছে দেখল, অনেকে বসবার রুমে বসে রয়েছেন। প্রতিদিন যারা ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আসেন, খাদেম তাদেরকে একটা রুমে বসিয়ে চা-নাস্তা খাওয়ায়। তারপর একজন একজন করে সিরিয়াল মত পাশের রুমে হুজুরের সঙ্গে দেখা করে। পাঁচ জনের পর আতাহরের সিরিয়াল এল। আতাহার রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, নদীতে চর জেগেছে। এর মধ্যে অনেকে কাগজ পত্র দেখিয়ে দখল পেয়েছে। তুমিও তাই কর। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় এখন তুমি স্বাবলম্বি হয়েছ। দোয়া করি, আল্লাহ আরো ত্বরক্কী দিক। তোমাকে মানুষের মত মানুষ করার জন্য যে সব শর্ত দিয়েছিলাম তা রহিত করা হল। এখন থেকে তুমি স্বাধীন। তবে বিয়ের আগ পর্যন্ত তুমি শবনমের সঙ্গে দেখা করবে না। তবে চিঠি পত্র দিতে পার। আর ইনশাআল্লাহ তোমাদের বিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে হবে। তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ, চাকরি করছে শুনে খুশি হয়েছি। দোয়া করি, ভবিষ্যতে দুনিয়াবী ও আখেরাতের সমস্ত পরীক্ষায় তোমাকে আল্লাহ উত্তীর্ণ করাক। এবার তুমি এস।
কৃতজ্ঞতায় আতাহারের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। চোখ মুছে কদমবুসি করে বলল, আবার কবে আপনার সঙ্গে দেখা করব?
চৌধুরী হুজুর মৃদু হেসে বললেন যখন আল্লাহ পাকের মর্জি হবে। সব সময় মনে রাখবে, আল্লাহ পাকের মর্জি ছাড়া দুনিয়াতে কোনো কিছুই হয় না। এবার তুমি যাও, আরো অনেকে অপেক্ষা করছে।
আতাহার সালাম দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসে বসবার রুমে সাখাওয়াত হোসেনকে দেখতে পেল। উনি তখন হুজুরের রুমে ঢুকতে যাবেন বলে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আতাহার সালাম দিয়ে বলল, চাচা আপনি? কেমন আছেন?
সাখাওয়াত হোসেন সেই ছোট বেলায় আতাহারকে দেখেছিলেন। তারপর এতদিন আর দেখেননি। তাই চিনতে পারলেন না। সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে তো আমি চিনতে পারছি না।
আতাহার বলল, আমাকে চিনতে পারলেন না চাচা? আমি আতাহার, মোজাম্মেল খন্দকারের ছেলে।
সাখাওয়াত হোসেন খুব অবাক হয়ে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলেন। সেই একটু খানি ছেলে আজ কত সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান হয়েছে। বললেন, ঠিক আছে, তুমি একদিন দোকানে আমার সঙ্গে দেখা করো। তারপর হুজুরের রুমে ঢুকে সালাম দিলেন।
চৌধুরী হুজুর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আতাহারের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
এই কথা শুনে সাখাওয়াত হোসেন অবাক হয়ে বললেন, জ্বি হয়েছে।
কেমন দেখলেন?
সাখাওয়াত হোসেন থতমত খেয়ে বললেন, জ্বি? জ্বি ভালো।
এখন তা হলে আর ওর সঙ্গে শবনমের বিয়ে দিতে অমত করবেন না?
আতাহারকে চিনতে পারার পর সাখাওয়াত হোসেন বেশ অবাক হয়েছিলেন। এখন হুজুরের কথা শুনে আরো বেশি অবাক হয়ে হাঁ করে হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চৌধুরী হুজুর বললেন, অত অবাক হচ্ছেন কেন? আল্লাহ পাকের ঈশারা মানুষের বোধগম্য নয়। আমি একদিন আপনাকে শবনমের বিয়ে দিতে নিষেধ করেছিলাম। আজ ডেকে পাঠিয়েছি, বিয়ে দেওয়ার জন্য। আর পাত্র হল আতাহার। সে এখন বি, এ, পাশ করে চাকরি করছে। তার মতো ছেলে আর পাবেন না। শবনম সুখী হবে। আর শুনুন, আপনি তো চরের জমি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন, সেই সঙ্গে আতাহার যাতে তার বাবার চরের সম্পত্তি ফিরে পায়, সে জন্য তাকে সাহায্য করবেন। আতাহার ছেলে মানুষ। কাগজপত্র তেমন বুঝবে না। আপনি সাহায্য করলে অনেক উপকার হবে।