পরের দিন নাসির উদ্দিন স্কুলে গিয়ে কুলসুমকে বলল, আতাহার বাড়িতে এলে আমাকে বলবে, আমি তার সাথে দেখা করব।
কুলসুম বলল, ভাইয়াতো আজ এসেছে। কাল হয়তো চলে যাবে।
নাসির উদ্দিন বলল, তা হলে তো আজকেই তার সঙ্গে দেখা করতে হয়?
কুলসুম বলল, আমি কি তোমার কথা ভাইয়াকে বলব।
না, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি সন্ধ্যের পর তোমাদের বাড়িতে যাব। এখন আসি বলে নাসির উদ্দিন চলে এল।
বাড়িতে এলেই শবনমকে দেখার জন্য আতাহারের মন পাগল হয়ে উঠে। তাই বেশি দিন থাকে না। মসজিদ শবনমদের ঘরের কাছে। নামায পড়তে গেলে শবনমের ভাই-বোনর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া নাসির উদ্দিন যদি নামায পড়তে আসে, তবে তার সাথে দেখা হবেই। এই সব কারণে মসজিদে না গিয়ে সে ঘরেই নামায পড়ে। আজ মাগরিবের নামায পড়ে কুলসুম ও খাদিজাকে পড়াচ্ছিল। এমন সময় নাসির উদ্দিনের গলা শুনতে পেল, আতাহার ঘরে আছিস? আতাহার চমকে উঠল। ভাবল, নিশ্চয় শবনম পাঠিয়েছে। তার সঙ্গে দেখা করবে কিনা চিন্তা করতে লাগল। নাসির উদ্দিনের গলা আবার শুনতে পেল, আতাহার আমি নাসির উদ্দিন, ঘরে থাকলে একটু বাইরে আয়। আতাহার বেরিয়ে এল।
তাকে দেখে নাসির উদ্দিন সালাম দিল।
আতাহার সালামের জওয়াব দিয়ে বলল, চল বাইরে কোথাও বসি।
ওদের বাড়ির অল্প দূরে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা। তারপর ধানের মাঠ। রাস্তায় এসে নাসির উদ্দিন বলল, তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে, মাঠে গিয়ে বসি চল।
মাঠে এসে দুবন্ধুতে আজ প্রায় দেড় বছর পর মুখোমুখি বসল। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ। তার আলোতে নাসির উদ্দিন দেখল আতাহারের চোখে পানি চিক চিক করছে। বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, উত্তর দিবি?
আতাহার মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানাল।
বাল্যবন্ধু হয়েও কি তোর ভালো-মন্দের কথা জিজ্ঞেস করতে পারি না? কি হয়েছে যদি বলতিস, তা হলে সাহায্য করতে না পারলেও মনে কিছুটা স্বস্তি পেতাম।
আতাহার চোখ মুছে বলল, বলার মতো হলে নিশ্চয় বলতাম। বাল্য বন্ধুর দাবিতে আমি তোর কাছে দাবি করছি, আমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবি না। আর …….।
নাসির উদ্দিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কিন্তু শবনম যে তোর চিন্তায় নিজে যেমন পাগল হচ্ছে তেমনি আমাকে তোর কথা জানার জন্য অস্থির করে তুলছে। ভালো হোক আর মন্দ হোক, কলেজে ওকে চিঠি দিয়ে জানা। এই দেড় বছরে তোকে পাগলের মত চিঠি দিয়ে যাচ্ছে, আর তুই কিনা তাকে একটারও উত্তর দিসনি। আমার তো ভয় হয়। শবনম আত্মহত্যা না করে ফেলে। আচ্ছা, তোদের মধ্যে কি কোনো ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে? অথবা কোনো ঝগড়া।
আতাহার তার মুখে হাত চাপা দিয়ে ভিজে গলায় বলল, তুই চুপ কর নাসির তুই চুপ কর। আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। আর শবনম কিছুতেই আত্মহত্যা করতে পারে না। আমি বলছি বলে বলবি না। তুই তাকে বলবি, ধৈৰ্য্যই সাফল্যের চাবি। কিন্তু সে তোর সঙ্গে অন্ততঃ একবারের জন্য হলেও দেখা করতে চায়।
না-না, তা কখনই সম্ভব নয় বলে আতাহার দ্রুত উঠে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
নাসির উদ্দিন তার পিছু নিয়ে বলল, আতাহার যাসনে শোন।
আতাহার যেতে যেতেই বলল তুই চলে যা, আমার কাছে আর আসবি না।
নাসির উদ্দিন ঘরে এসে সব কথা শবনমকে বলল।
শবনম শুনে ফুঁপিয়ে উঠল।
নাসির উদ্দিন বলল, কাঁদছিস কেন? সে তোকে শুধু বলতে বলল, ধৈৰ্য্যই সাফল্যের চাবি।
শবনম সামলে গিয়ে বলল, হ্যাঁ কথাটা আতাহার ভাই প্রায় আমাকেও বলত।
সেইদিন রাতে শবনম আতাহারকে শেষ বারের মতো চিঠি লিখতে বসল।
আতাহার ভাই,
প্রথমে তোমার পদপ্রান্তে শত কোটি সালাম ও অন্তর উজাড় করে ভালবাসা জানালাম। এই দেড় বছর ধরে তোমাকে যে কত চিঠি দিয়েছি, তা তুমিও জান। এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ চিঠি। আজ মেজ ভাইয়ের কাছে তোমার সব কথা শুনলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। কেন যে তুমি নীরব হয়ে গেলে আল্লাহ মালুম। আমাকে কোনো কারণে ঘৃণা করে মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ কিনা অথবা অন্য কোনো কারণে তোমার এই নীরবতা, তা জানার বড় ইচ্ছা হয়। জানি এই চিঠির উত্তরও আমি পাব না। কারণ আমার মন বলে, এই দেড় বছরে যত চিঠি তোমাকে দিয়েছি সেগুলো পড়নি। হয় জ্বালিয়ে ফেলেছ, না হয় ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছ।
যা কিছুই কর না কেন? আমি তোমার কথা আমরণ মনে রাখব। আল্লাহ ছাড়া কোনো মানুষ আমাকে আমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারবে না। যে উদ্দেশ্যে তুমি নীরব হয়ে গেছ, সেই উদ্দেশ্য আল্লাহ তোমার পূরণ করুক, এই দোয়া চেয়ে শেষ করছি-আল্লাহ হাফেজ।
ইতি
তোমার শুধু তোমারই শবনম।
এতদিন শবনম যত চিঠি দিয়েছে, আতাহার একটাও পড়েনি। সব বাক্স বন্দী করে রেখেছে। কারণ পড়লে শবনমের চিন্তা তাকে পাগল করে দেবে। তাই শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মনকে শক্ত করে বাক্সে তুলে রাখে আর ভাবে, আল্লাহ যে দিন তাদের মিলনের বাধা দূর করে দেবেন, সেদিন শবনমকে দিয়েই তার চিঠি পড়াবে। এবারে ঢাকায় ফিরে শবনমের এই চিঠিটাও বেদনা ভরা মনে আগের গুলোর সঙ্গে রেখে দিল।
.
১১.
চার বছর পরের ঘটনা। নাসির উদ্দিন বি, এ, পাশ করে তার বাবার পোস্টে কাজ করছে। সাখাওয়াত হোসেন রিটায়ার্ড করে দৌলতখান বাজারে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দিয়েছেন। সামসুদ্দিন তিন বছরের একটা ছেলে ও এক বছরের একটা মেয়ের জনক হয়েছে। কলিম উদ্দিন এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। আসমা নাইনে পড়ছে। শবনমের সঙ্গে আতাহারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। সে কথা তাদের দুই পরিবারের সবাই জেনে। গেছে। স্বামীকে শবনমের বিয়ের ব্যাপারে যুবাইদা খানম বার বার বলেন। সাখাওয়াত হোসেন মিথ্যে করে বলেন, চেষ্টা তো কম করছি না। কিন্তু ভালো ছেলে তো পাওয়া যাচ্ছে না। উনি মাঝে মাঝে কলাকোপায় গিয়ে চৌধুরী হুজুরের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু সাহস করে শবনমের বিয়ের কথা বলতে পারেন না। চৌধুরী হুজুরও কিছু বলেন না। মজিদ শালীর জন্য এবং সামসুদ্দিন বোনের বিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু শবনমের উপযুক্ত কোনো ছেলে পাচ্ছে না।