শবনম মায়ের কাছে এসে আলমাস যা যা বলে গেল, তা বলল।
যুবাইদা খানম স্বামীর কাছে চৌধুরী হুজুর যে বুজুর্গ লোক, তা শুনেছেন। বললেন, তোর আব্বা হয়তো সামনের সপ্তাহে আসবে। আমার মনে থাকে কি না থাকে, তুই মনে করে বলিস।
সেই দিন বিকেলেই সাখাওয়াত হোসেন বাড়ি এলেন। ছেলের বিয়ের আর মাত্র দশ দিন বাকি। তাই এক মাসের ছুটি নিয়ে এসেছেন। সামসুদ্দিনকেও সঙ্গে আনতে চেয়েছিলেন; কিন্তু এত আগে সে ছুটি পেল না। বিয়ের তিন দিন আগে আসবে।
সন্ধ্যের পর যুবাইদা খানম চৌধুরী হুজুরের ডেকে পাঠাবার কথা স্বামীকে বললেন।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, উনি তা হলে এখন এখানে আছেন। কাল সকালেই ওঁর কাছে যাব। সামসুদ্দিনের বিয়ের কথা বলে দাওয়াতও দেব।
পরের দিন নাস্তা খেয়ে চট্টগ্রাম থেকে আনা কিছু ফল ও মিষ্টি নিয়ে সাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী হুজুরের কাছে গেলেন।
সালাম বিনিময়ের পর চৌধুরী হুজুর তাকে বসতে বলে বললেন, আপনি শবনমের বিয়ের ব্যাপারে কোনো চেষ্টা করবেন না। আল্লাহপাক যখন রাজি হবেন তখন হবে।
সাখাওয়াত হোসেন অবাক হয়ে বললেন, হুজুর আমার মেয়েকে চেনেন দেখছি? তারপর বললেন, তাই হবে হুজুর।
চৌধুরী হুজুর বললেন, আর একটা কথা, এই ব্যাপারটা কাউকে বলবেন না। এমন কি আপনার স্ত্রী বা ছেলে মেয়েদেরকেও না। এবার আপনি আসুন।
সাখাওয়াত হোসেন বললেন, হুজুর আমার বড় ছেলে সামসুদ্দিনের চৌদ্দ দিন পর বিয়ে। যদি মেহেরবানী করে দাওয়াত কবুল করতেন।
চৌধুরী হুজুর আলহামদুলিল্লাহ বলে বললেন, দাওয়াত কবুল করা সুন্নত। আল্লাহপাক যদি অতদিন আমাকে এখানে রাখেন, তা হলে ইনশাআল্লাহ যাব।
সাখাওয়াত হোসেন সালাম বিনিময় করে চলে এলেন। আসার পথে চিন্তা করলেন, উনি শবনমকে চিনলেন কেমন করে? আবার তার বিয়ে না দিতে এবং ওঁর কথা কাউকে বলতেও নিষেধ করলেন। তা হলে কি ওঁর হাতে কোন পাত্র আছে? যাই হোক হুজুর যখন বলেছেন তখন নিশ্চয় এর ভিতর কোনো ভেদ আছে।
শবনম নাসির উদ্দিনের মুখে আতাহারের ঢাকা চলে যাবার কথা শুনে সেই দিনই চিঠি লিখে তাকে পোস্ট করতে দেওয়ার সময় বলল, তোর নামে চিঠি দিতে বলেছি। চিঠি এলে আমাকে দিবি। কিন্তু এক মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও চিঠির উত্তর এল না। এই ভাবে তিন মাস চিঠি দিয়েও যখন আতাহারের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেল না। তখন খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। নাসির উদ্দিনকে প্রায় চিঠির কথা জিজ্ঞেস করে।
নাসির উদ্দিন বলে, আতাহার ভাই চিঠি দেয়নি। দিলে তোকে ঠিক দিতাম।
এদিকে এস, এস, সির রেজাল্ট বেরোল। শবনম ও নাসির উদ্দিন ফাষ্ট ডিভিসনে পাশ করেছে। নাসির উদ্দিন দৌলতখান আবু আব্দুল্লাহ কলেজে আর শবনম দৌলতখান মহিলা কলেজে ভর্তি হল।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শবনম আতাহারকে চিঠি দিয়ে তার কলেজের ঠিকানায় চিঠি দিতে জানাল। ভেবেছিল, নাসির উদ্দিন হয়তো তার চিঠি মেরে দেয়। এবার নিশ্চয় আমি পাব। কিন্তু মাস গড়িয়ে বছর পার হয়ে যেতেও যখন আতাহারের চিঠি পেল না তখন তার মনে সন্দেহ হল। ভাবল, তা হলে কি সে আমাকে ভুলে গেল। কথাটা ভেবে মনে ভীষণ ব্যথা পেল। চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তকদিরের কথা চিন্তা করে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর আল্লাহকে জানাল, আল্লাহ তুমি আমার তকৃদিরে যদি এটাই লিখে রেখেছিলে, তা হলে আতাহারকে ভালবাসার সুযোগ কেন দিলে? একদিন নাসির উদ্দিনকে বলল, আতাহার ভাই বাড়িতে এলে তোর সঙ্গে দেখা হয়?
নাসির উদ্দিন বলল, হয়, তবে আমাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। একদিন তাকে বলেছিলাম, আমি কি তোর দুশমন। আমাকে দেখলে তুই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাস কেন? বলল, তোর কোনো কথার উত্তর দিতে পারব না বলে চলে যাচ্ছিল। আমি তার পথ আগলে বললাম, আমার কথার উত্তর না হয় নাই দিতে পারলি; কিন্তু আজ এক বছর হয়ে গেল, শবনমের চিঠির উত্তর দিস না কেন? তোর কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, সে কথাও বলতে পারব না। তারপর হন হন করে চলে গেল। আমার মনে হয়, এমন কিছু একটা হয়েছে, যে জন্যে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
শবনম বলল, খেয়াল রাখবি, এবারে আতাহার ভাই এলে যেমন করে হোক তার সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে। আর সে ব্যাপারে তোকে সাহায্য করতে হবে।
আতাহার নাসির উদ্দিনকে এড়িয়ে চললেও এবং নাসির উদ্দিন তার বোনদের পড়ান বন্ধ করে দিলেও সে স্কুলে কুলসুমের সঙ্গে দেখা করে। একদিন আতাহারের কথা জিজ্ঞেস করতে কুলসুম বলল, বেশ কিছুদিন থেকে ভাইয়া যেন কেমন হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে কোথাও যায় না। এমন কি মসজিদেও নামায পড়তে যায় না। দুএকদিন থেকে চলে যায়। সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকে। আমাদের সঙ্গেও আগের মত হেসে কথা বলে না। ভাইয়ার পরিবর্তন দেখে আম্মা একদিন জিজ্ঞেস করতে বলল, আমি একটা সাধনা করছি। তুমি দোয়া কর, আল্লাহ যেন আমাকে সফলতা দেন। আম্মা বলল, তা না হয় দোয়া করব; কিন্তু তুই বাড়িতে দুএকদিনের বেশি থাকতে চাস না কেন? ভাইয়া বলল, বেশি দিন ছুটি পাই না তাই। সেদিনের পর থেকে নাসির উদ্দিন কুলসুমকে আর আতাহারের কথা জিজ্ঞেস করেনি। তবে তার ও খদিজার পোষাক পরিচ্ছদ দেখে বুঝতে পারে। আতাহারের আয় বেড়েছে। এখন শবনমের কথা শুনে বলল, ঠিক আছে চেষ্টা করব।