ক্ষমা চাইলাম, তবুও রাগ করলেন।
ক্ষমা চাওয়ার মত অন্যায় করেছেন কি না জানি না, তবে আমি আমার কথার নড়চড় কোনোদিন করি না। রিক্সায় না গেলে বরং আমিই মনে কষ্ট পাব।
নাসিমা বুঝতে পারল, মুবিন খুব সেন্টিমেন্টাল ও একরোখা। ভিজে গলায় বলল, প্লীজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। কথাটা আমি এমনিই বলেছি। আপনি এভাবে নেবেন জানলে বলতাম না।
জানেন বোধ হয়, প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু দোষ থাকেই। আমারও আছে। তার মধ্যে আমার একটা বড় দোষ, আমি যা একবার না বলি, তা আর হ্যাঁ হয় না। তাই আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেও আপনার সঙ্গে যেতে পারছি না। সে জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে কাল যদি আসেন, তা হলে কথা দিচ্ছি যাব।
নাসিমা আর কোনো কথা না বলে চোখ মুছতে মুছতে রিক্সায় উঠল।
রিক্সা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর মুবিন বাসার পথ ধরল।
সেই দিন রাতে মুবিন বড় ভাবিকে নিজের মতামত জানিয়ে নাসিমার অভিভাবকদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলে চিঠি লিখল।
পরের দিন অফিসে যাওয়ার পথে সেটা পোষ্ট করে দিল। গতকালের ঘটনায় মুবিনের মনে শান্তি নেই। সেই থেকে তার কেবলই মনে হয়েছে নাসিমা মনে কষ্ট পেয়েছে। ভেবেছে, কাল যদি আসে, তা হলে তাকে খুশি করার চেষ্টা করবে। অফিসে কাজ করতে করতে বার বার গতকালের ঘটনা মনে পড়ছে। হঠাৎ খেয়াল হল, তাকে আজ আসতে বললাম, কিন্তু কোথায় আসবে বলিনি। ওতো আমার বাসার ঠিকানা জানে না। যদি আসে, তা হলে কি মার্কেটে ঐ দোকানে আসবে? ভেবে রাখল, ছুটির পর ঐ দোকান হয়ে বাসায় ফিরবে।
মুবিনের ছুটি হয় পাঁচটায়। আজ নাসিমার চিন্তায় পাঁচটা পর্যন্ত থাকতে পারল না। ভাবল, সে হয়তো মার্কেটে এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই চারটের সময় ম্যানেজারকে বলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেটের বাইরে এসেছে এমন সময় নাসিমাকে আসতে দেখে মন আনন্দে ভরে গেল।
নাসিমা গতকাল বাসায় ফেরার সময় চিন্তা করল, মুবিন ভাই যা বলল, তা সত্যি, না ডাঁট দেখাল? যদি ডাঁট দেখায়, তা হলে তো সে অহঙ্কারী। তার এক মন বলল, যা স্বাভাবিক তাই তুই বলেছিস, তাতে মাইন্ড করবে কেন? এটা সে ডাঁটই দেখিয়েছে। তা না হলে তোর মনের খবর জানার পরও ঐ সামান্য কথায় রাগ করতে পারে না। আর এক মন বলল, তা কি করে হয়? যারা ধার্মীক তারা অহঙ্কারী হতে পারে না। তারা ভঁটও দেখাতে পারে না। সত্যি সত্যি হয়তো ছোটবেলা থেকেই ঐরকম। সিদ্ধান্ত নিল, কাল তার সঙ্গে দেখা করে সত্য মিথ্যা যাঁচাই করবে।
পরের দিন বেলা আটটার সময় ওয়াহাব ঢাকা থেকে ফিরে মালপত্র অফিসে বুঝিয়ে দিয়ে একটার দিকে বাসায় এল।
ওয়াহাব খাওয়া দাওয়ার পর যখন রেস্ট নিচ্ছিল তখন নাসিমা তার কাছে এসে বলল, তুমি আজ বিকেলে বাসায় থাকবে।
কেন?
কেন আবার থাকতে বললাম থাকবে।
তা না হয় থাকব; কিন্তু কারণটা বলবি তো।
এখন বলব না, থাকলেই জানতে পারবে।
ঠিক আছে এখন যা একটু ঘুমাব।
নাসিমা মুবিনের বাসার ঠিকানা জানে না। তাই অফিস ছুটির আগে এসে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল। মুবিনকে বেরোতে দেখে এগিয়ে এসে সালাম দিল।
মুবিন সালামের উত্তর দিয়ে হাসিমুখে বলল, ক্ষমা পেয়েছি তা হলে?
নাসিমা বলল, আপনি একথা বলছেন কেন? বরং অন্যায় তো আমি করেছি। কাল ক্ষমা চেয়ে পাইনি। আজ আবার চাইতে এলাম।
মুবিন লজ্জা পেয়ে বলল, গতকালের ঘটনার জন্য সত্যি খুব দুঃখিত। চলুন কোথাও বসি।
আজ আর কোথাও বসব না বাসায় চলুন।
বেশ তাই চলুন বলে মুবিন হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, এখান থেকে ওদের বাসায় হেঁটে যেতে আধ ঘন্টা সময় লাগবে। এতটা পথ নাসিমাকে নিয়ে হেঁটে যাওয়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া অফিস ছুটির পর তারও ক্লান্তি লাগছিল। একটা খালি স্কুটার আসতে দেখে থামাল। তারপর নাসিমাকে বলল, উঠুন।
নাসিমাও ঐ একই কথা চিন্তা করে স্কুটারের কথা চিন্তা করছিল। তাই কিছু না বলে উঠে বসে বলল, আপনি স্কুটার না থামালে আমি থামাতাম। বাসার কাছে পৌঁছে স্কুটার থেকে নেমে মুবিন ভাড়া দিতে গেলে নিজের অজান্তে নাসিমা তার হাত ধরে ফেলে বলল, আপনি দিচ্ছেন কেন? আমি আপনাকে নিয়ে এসেছি।
নাসিমা হাত ধরাতে মুবিন সারা শরীরে এক অজানা শিহরণ অনুভব করে কোন কথা বলতে পারল না। এক দৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নাসিমা ভীষণ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিল। তারপর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে কোন রকমে বলল, আসুন।
এমন সময় আসরের আযান হতে শুনে মুবিন বলল, আপনি যান, আমি নামায পড়ে আসছি। নাসিমাদের বাসার পাশে মসজিদ। ওয়াহাবের অসুখের সময় এসে ঐ মসজিদে একদিন নামায পড়েছিল।
নাসিমা ঘড়ি দেখে বলল, জামাতের সময় এখনও বিশ মিনিট বাকি। ভাইয়ার সঙ্গে যাবেন। আসুন আমার সঙ্গে।
মুবিন অবাক হয়ে যেতে যেতে বলল, আপনার ভাইয়া ফিরেছেন?
জ্বি, আজই ফিরেছে।
ওয়াহাব ঘুম থেকে উঠে নাসিমাকে দেখতে না পেয়ে মাকে জিজ্ঞেস করল, নাসিমা কোথায়?
সারা বেগম বললেন, কোথায় যেন গেল। যাওয়ার সময় বলল, ভাইয়াকে থাকতে বলো।
ওয়াহাব চিন্তা করতে লাগল, নাসিমা কোথায় গেছে? আর আমাকেই বা থাকতে বলল কেন? বলল, ভেবেছিলাম মুবিনের সঙ্গে আজ দেখা করব।
ওয়াহাব বোনের মনোভাব বুঝতে পারার পর একদিন মা-বাবাকে বলেছিল। আমি নাসিমার জন্য মুবিনকে পছন্দ করেছি। আমার এক কলিকের বাড়ি ওদের পাশের গ্রামে। তার কাছে সব খোঁজ খবরও নিয়েছি। সে বলল, মুবিনের মত ছেলে আজকাল পাওয়া যায় না। ওদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা খুব ভালো। কিছুদিন আগে দৌলতখানে বিয়ের কথা হয়েছিল। মুবিন প্রথমে রাজি থাকলেও পরে অমত করেছে। তাই বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। ভাবছি, একবার ওর সঙ্গে গিয়ে সব কিছু দেখে আসব।